মূল চিঠি:
প্রিয় অনুজ,
২০২১ এর আজকের এই পড়ন্ত বিকেলে তোমাকে উদ্দেশ্য করে লিখছি, তুমি হয়তো এমনি কোন বিকেলে ঘরে বসে কম্পিউটার গেম খেলছো। তোমাকে আজকে বলবো আজ থেকে আরো কুড়ি বছর আগে এক পড়ন্ত বিকেলের গল্প। যখন আমাদের খেলার জন্য কোন কম্পিউটার ছিলনা, বিশাল বড় পুরো বাড়িই ছিল আমাদের খেলার জায়গা।
জানো তো আমাদের বাড়ি ছিল গাইবান্ধায়। গ্রামের নাম কিশামত মালিবাড়ি, সরকার পাড়া। আমার দাদুর নাম ছিল জয়েন উদ্দিন সরকার। উনার ছিল তিন মেয়ে আর ছয় ছেলে। বড় পরিবার হয় আমাদের দাদু আনুমানিক ৬০ এর দশকে বিশাল জায়গা জুড়ে একটি বড় বাড়ি তৈরি করেন, সেই থেকে আমাদের বাড়ি ‘বড় বাড়ি’ নামে পরিচিতি পায়। আজকে তোমাকে সেই ‘বড় বাড়ির’ গল্প বলছি।
আমাদের বাড়িতে দুইটা বড় উঠান ছিল। একটা ছিল ভেতরের উঠান যাকে আমরা ‘আইগ্নো’(আঙিনা) বলতাম, আর একটা ছিল বাড়ির পূর্বদিকে বাহিরের উঠান, যাকে আমরা ‘বাইরাগ’ (বাড়ির আগে> বাড়ির সামনে) বলতাম। প্রকৃতপক্ষে বিশাল বড় উঠান দুইটা ছিল বড়দের ধান-গম মাড়াই ও শুকানোর জায়গা, যা কিনা বিকেলে হয়ে উঠত ছোটদের খেলার মাঠ..! সেই উঠানে আমরা পাড়া ছেলেমেয়েরা মিনিট কতকিছু খেলতাম তার ইয়াত্তা নেই…! কানামাছি, গোল্লাছুট, দারিয়াবান্দা, মার্বেল, ডাঙ্গুলি, লুকোচুরি, ফুটবল,ক্রিকেট আরো কত্তকি..। ভেতরের উঠান কে কেন্দ্র করে চারিদিকে ছিল অনেকগুলো ঘর। তার মধ্যে পূর্ব দিকের একটি ঘর ছিল বৈঠকখানা, অন্য একটি ছিল অতিথির থাকার ঘর। অন্য ঘরগুলোতে পরিবারের লোকজন থাকতো। উঠানের উত্তর-পশ্চিম কোণায় ছিল বেশ বড়সড় রান্নাঘর। রান্না ঘরের ভেতরে মাদুর পেতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। রান্নাঘরের পশ্চিম দিক ছিল নলকূপ আর উত্তর দিকে পায়খানা উঠানের উত্তর-পূর্ব দিকে ছিল বিশাল বড় শান বাঁধানো ইন্দিরা ও গোসলখানা। মজার ব্যাপার হল বিশাল ইন্দিরার দুইটা অংশ ছিল, বাইরের অংশটা ছিল পাড়ার মানুষজনের ব্যবহারের জন্য, আর ভেতরের অংশ আমাদের ব্যবহারের জন্য। এ কারণে বাড়িটি যেমন বাড়ীর মানুষদের আগলে রাখত, তেমনি পাড়ার মানুষদের সেবা করতো..। ইন্দিরার পাশেই ছিল গোসলখানা। মেয়েরা ইন্দিরা থেকে পানি তুলে নিয়ে গোসলখানায় গোসল করত, আর পুরুষরা গোসল করত সান বাঁধানো ইন্দিরার পাড়েই। বাহিরের উঠানের উত্তর দিকে ছিল গোয়াল ঘরের সারি। আর পূর্বদিকে এক বড় পুকুর। পুকুরপাড়ে অনেক অনেক গাছ ছিল। তবে পুকুরের ওপরে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটি আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল। সেই গাছের ডাল থেকে আমরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।আমাদের বাড়িতে ঘরগুলোর মেঝে ছিল উঠান থেকে প্রায় দুই ফুট উঁচু। পূর্বদিকের দুইটা ঘরের মাঝখানে দিয়েছিল বাড়ির ভেতরে আসার মূল রাস্তা, যাকে আমরা সুলি সুলি বলতাম। বাড়ির বাইরের উঠান থেকে কয়েকটা ধাপ (সিঁড়ি) উঠে সেই সুলি অতিক্রম করে আবার কয়েকটা ধাপ নিচে নেমে আঙিনায় আসতে হতো। আমাদের বাড়িতে সবগুলো থাকার ঘর ছিল উপরে টিনের চাল লাগানো চৌচালা ঘর। কিন্তু বেড়াতে ছিল ভিন্নতা। পূর্ব দিকের ঘরগুলোতে ছিল টিনের বেড়া উত্তর দিকের ঘরে ছিল কাঠের বেড়া। কাঠের বেড়াগুলোতে আঁকা ছিল ফুল, পাখি ও বিভিন্ন রকম কারুকার্যপূর্ণ নকশা। কাঠের ঘর গুলিতে শাল গাছের শক্ত খুঁটি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা অনেক বছর পর্যন্ত টিকে ছিল । দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের ঘরগুলোতে ছিল চুন-সুরকি (সিমেন্ট এর পরিবর্তে) ব্যবহৃত ইটের গাথুনির দেয়াল। এই চুন-সুরকির দেয়াল ওয়ালা ঘরের গরমের সময়ও বেশ শীতল পরিবেশ থাকতো। পূর্বদিকের ঘরগুলোর ভেতরে ও বাহিরে বারান্দা ছিল, আর অন্যদিকে ঘরগুলোতে ছিল শুধু ভেতরের দিকে।
বাড়ির চারিদিকে বিভিন্ন ফল ও ফুলের গাছ ছিল। ফল ও ফুলের মৌসুমের ঘ্রানে বাড়ির চারিদিক মৌ মৌ করতো। বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোনায় ছিল নারিকেল গাছের সারি। উত্তরদিকের ঘরের পেছনে কাঁঠাল গাছের সারি, আর পশ্চিম দিকের ঘরের পেছনে বড় দুটো লিচু গাছ । লিচু গাছের পরে ছিল সুপারি বাগান। সুপারি বাগানের পরে বড় আম গাছের সারি। ঝড়ের সময় গোটাপাড়ার ছেলেমেয়েরা আসত আম কুড়াতে। সবাই মিলে আম কুড়াতে কি যে মজা..! আম গাছের সারির পরেই ছিল বাঁশ ঝাড়। আমার বাবা খুব ফুল ভালোবাসতেন। উনি বিভিন্ন রকমের ফুল গাছ সংগ্রহ করে বাগানে লাগাতেন। ভেতরের উঠানে প্রতি সাইডের ঘরগুলোর সামনে ছিল ফুলের বাগান। বাড়িতে ঢোকার রাস্তার সাথে ছিল সুন্দর মাধবীলতা ফুল, উত্তরের ঘরের দরজার সামনে ছিলো বাগানবিলাস, আর পশ্চিমের দিকে নলকূপের পাড়ে ছিল হাসনাহেনা। ফুলের সুবাসে ভারী হয়ে উঠত বাড়ির বাতাস।
শৈশবের সেই আনন্দঘন দিনগুলোর কথা তোমাকে জানাতে পেরে ভালো লাগছে। অবশেষে বলতে চাই যৌথ পরিবারের সবাই মিলে একসাথে বসে খাওয়ার যে কি আনন্দ তা শত কোটি টাকা দিয়েও তুমি কিনতে পারবে না। শুধুমাত্র এই বাড়িটির কারণে সে আনন্দটুকু আমরা উপভোগ করতে পেরেছি। সম্ভব হলে আমাদের স্মৃতি জড়িত এ বাড়িটি বাঁচিয়ে রেখো।
তোমার অগ্রজ
প্রেরক: ইয়াসির আফিয়াত রাফি
পেশাঃ স্থপতি
বয়সঃ ২৬
বাড়িঃ গাইবান্ধা ( কিশামত মালিবাড়ি, সরকার পাড়া, পোষ্টঃ হাট দারিয়াপুর, গাইবান্ধা সদর)
পিতাঃ মোঃ মোজাম্মেল হক সরকার
মাতাঃ মোছাঃ কোহিনুর বেগম
দাদার নামঃ জয়েন উদ্দিন সরকার (পেশাঃ এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন)
English Version | Translated by Mahin Haque
My Dear Younger Ones,
I’m writing this letter to you on a fine afternoon of 2020. And I guess, many years later, on a similar afternoon like this- you might be spending your free time playing computer games at home. Today, let me tell you the story of another beautiful afternoon twenty years ago, when we were kids and had no such thing as computers to play with; instead, we had our own house as a huge playground. Can you believe it?
Our ancestral home was located in a village called Kishamat Malibari, Sarker Para in Gaibandha district in North Bengal. The name of my grandfather was Joyen Uddin Sarker. He had three daughters, and six sons. Since my grandfather had such a large family, he built this big house during the ‘60s to accommodate his full family in it. And thus everyone started to call our house ‘Boro Bari’, which literally means ‘Big House’. Today I am telling you the story of the ‘Boro Bari’.
The house had two large courtyards. One was an inner court, which we called ‘aigna’ (derived from ‘angina’ meaning private yard), another was an exterior court on the east side of the house, which we called ‘bairag’ (meaning outside yard). In fact, these two large yards were generally used by the adults to thresh paddy and wheat during the daytime, which became the children’s playground in the afternoon. We along with the children of our neighborhood used to play together various games in that yard; such as- kanamachi, gollachut, marble, danguli, lukochuri, cricket, football etc. There were many separate rooms around the inner courtyard of the house. One of the rooms on the east side was the living room, and the other was the guest room. The rest of the rooms were for the family members. In the northwest corner of the yard was a large kitchen. Inside the kitchen, there was provision for spreading a mat on the floor as a seating arrangement during mealtime. A tube well was on the west side of the kitchen, while the toilet was in the north. On the northeast side of the courtyard were a large paved ‘indira’ and a bathhouse. The most interesting thing about the huge indira was it had two parts; the outer part was for the use of the people of the neighborhood, and the inner part was for the use of our family members. For this reason, just as the house was a safe haven for its inhabitants, it also served the people of the neighborhood. The bath house was right next to the indira. The women and girls used to fetch water from the indira and took a bath in the adjacent bath house, while the men used to bathe on the open platform of the paved indira. To the north of the outer courtyard was the barn. And a big pond was located on the east side. There were many trees on the bank of the pond. However, the krishnachura tree leaning on the pond was our favorite. We used to jump into the pond from the branches of that tree.
The floor height (plinth level) of the rooms in our house was about 2 feet high from the ground level of the yard. The main entrance to the house was between the two parts of the house on the east side; which we called ‘suli’ (narrow alley). We had to climb a few steps (stairs) from the outer yard, cross that narrow alley and come down a few steps again to reach the inner courtyard. All the living rooms in the house were tin-roofed ‘chauchala ghor’. But there were differences on the walls, as different materials were used in different portions. The houses on the east side had tin walls, while the houses on the north had wooden walls. The wooden walls were decorated with various artistic designs including floral patterns and drawings of birds, trees etc. Hard thick poles made of ‘shal tree’ wood were used to erect the structure of the tin-shed and wooden houses, which lasted for many years. The houses on the south and west sides were made of brick walls plastered with lime-surkhi (instead of cement). These lime-walled rooms had a cool atmosphere inside even during the hot seasons. The houses on the east side had verandahs on both inside and outside. However, the rest of the houses used to have only inside verandahs.
There were various fruit and flower trees around the yards, from where sweet fragrance spread all over the house during the monsoon seasons. There were rows of coconut trees in the north-east corner, rows of jackfruit trees on the north, and two large litchi trees on the west side. Right next to the litchi trees, there was a betel garden; and rows of large mango trees. During the storm, little boys and girls from the whole neighborhood used to come here in order to pick mangoes. I remember, it was a very fun thing to do; picking mangoes together. There was also a big bamboo bush right next to the rows of mango trees.
My father had a great love and affection for flowers, so he used to collect different types of flower seeds and plant them in the garden. In the inner courtyard, a flower garden was grown in front of the houses on each side. The main entrance to the house was lined with beautiful ‘madhavilata’ flowers, while ‘baganbilas’ sprouted in front of the north entry door, and ‘hasnahena’ bloomed on the west bank of the tube well. As soon as evening fell, the air of the house became heavy with the beautiful sweet fragrance of many different flowers.
It feels really nice to tell you all about those happy days of my childhood. Finally, I would like to say that you can never buy the joy and simple happiness of sitting and eating together in a joint family, no matter how much money you are willing to spend for it. And I was very lucky to grow up in such an environment. And not to mention, it is only because of this great house that we were able to enjoy this kind of happiness; and now can relive the childhood nostalgia. If possible, please keep the house alive, so that the memories live on.
With love,
Your Elder
হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।
আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।
বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/
ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com
Disclaimer:
CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website.