নগরজীবন ও স্থাপনার গল্প─ রেনজো পিয়ানো | The Story of City-life & Buildings─ Renzo Piano

28 June, 2020 Total View: 34

Tjibau Cultural Centre by Renzo Piano | Illustration by: Kazi Fariha Tasnim Richie

মুখবন্ধ

স্থাপত্যশিল্পের দুনিয়ায় রেনজো পিয়ানোকে ‘জাদুঘরের গুরু’ হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে । এই স্থপতির ডিজাইন করা জাদুঘরের সংখা ২৫, যেগুলোর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৪টি ! অর্থাৎ কিনা , খুব নিরাপদেই এ সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় যে, জাদুঘরগুলোর দন্ডমুন্ডের কর্তারাই বলুন বা দর্শনার্থী সমঝদার অথবা সাধারণ নাগরিক, এরা কি চান এবং আসলেই এদের কি  প্রয়োজন , তা রেনজো পিয়ানো এবং  তার দলের লোকেরা  যত ভালো বোঝেন তেমনটা আর কম লোকেই বোঝে।

তবে প্রায়শই যে ব্যাপারটা উহ্য থেকে যায়, সেটা হলো, পিয়ানোর ডিজাইন করা বিল্ডিংগুলো বিশেষ করে শিল্প-জাদুঘরগুলো কী দারুনভাবে তাদের পারিপার্শ্বিকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ! এসব স্থাপনাগুলো এমনভাবে শহরের জীবনযাত্রার সাথে অভিযোজিত যেন তারা চিরকাল সেখানেই ছিল ! ‘সেন্টার পম্পিদু’ থেকে শুরু করে ‘ নিউ ইয়র্ক টাইমস বিল্ডিং’, এগুলোর প্রত্যেকটিই স্থান এবং স্থানিকতার শক্তিকে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করতে পেরেছে ।

ইদানিংকালে তার দুটি বহুল আলোচিত মিউজিয়াম প্রজেক্ট এর কাজ (হার্ভার্ড আর্ট  মিউজিয়াম, কেমব্রিজ ও হুইটনি মিউজিয়াম অফ আর্ট , লোয়ার মান্হাটন ) শেষ হয়ে আসার প্রাক্কালে তার মিট প্যাকিং ডিস্ট্রিক্ট এর অফিস এ বসে কথা বললেন, সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া , সমালোচনা, সমসাময়িক স্থাপত্যচর্চা এবং তথাকথিত ‘উড্ডীন-স্থাপনা’ বা ‘ফ্লাইং বিল্ডিং’ বিষয়ে ।

স্থাপত্য ‘ফ্যাশন’ নয় !

ক্লেমেন্স – একটা স্থাপনার কল্পনা -স্ফুরণ থেকে শুরু করে  সেটা একটা বাস্তব স্থাপনায় পরিণত হওয়া পর্যন্ত এটা একটা দীর্ঘ যাত্রা পথ ! কতগুলো বছর পেরিয়ে যায় একটা নতুন চিন্তা সুসংহত হয়ে স্থাপতিক বাস্তবতায় রুপান্তরিত হতে !  এই দীর্ঘসুত্রি প্রক্রিয়াটাকে  আপনি কিভাবে দেখেন  ?

পিয়ানো –     হ্যা, এ এক সংগ্রামই বটে ! এটা সব জায়গায়ই সত্যি যে, একটি নান্দনিক স্থাপনা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া এবং তারপর মানুষের উপলব্ধির জায়গাটায় সেটার স্থান করে নেয়া, দুটোই দীর্ঘ সময়াপেক্ষ ব্যাপার। প্রথম দিনেই কোনও স্থাপত্যকে চেনা বা বোঝা যায়না, স্থাপত্য ‘ফ্যাশন’ নয়। আমি ‘ফ্যাশন’-এর বিরুদ্ধে কিছু বলছিনা, যেটা বুঝাতে চাইছি তা হল ; ‘ফ্যাশন’ হঠাৎ করে এবং দ্রুত ঘটে যায়, আর স্থাপত্য একটা ধীরলয় প্রক্রিয়া।  ঠিক যেমন একটা শহরের গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া বা একটা নদী অথবা কোন অরন্য অনেকটা সময়ের ব্যাপার ! একটি স্থাপত্যকে বুঝতে এবং তাকে ভালবাসতে বহুদিন লেগে যেতে পারে । যেমনটা পম্পিদ্যু সেন্টারের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।  যখন এটা প্রথম উদ্বোধন হল, অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো । প্যারিসের লোকেদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা  পেতে প্রায় ১০-১৫ বছর লেগে গিয়েছিল। তবে এর চেয়ে কমেও হয়। একটা নতুন মিউজিয়ামের অসুবিধাই এটা যে, এটা ‘নতুন’ । শহরের দৈনন্দিনতার ভিতর দিয়ে এখনো তার যাত্রা শুরু করেনি, যার মধ্য দিয়ে এটা  সেই শহরের জন্য গ্রহণযোগ্য ও প্রিয় হয়ে উঠবে । একটা সিনেমাহল, বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর বা চার্চ , যাই হোক না কেন, সেটাকে তার শহরের প্রাত্যহিকতার অংশ হয়ে উঠতে হয়।

ক্লেমেন্স – একটা নতুন স্থাপনা, তার শহরে বা শহরের কোন একটা অংশে একটা মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে যা অনেক সময়ই মেনে নেয়া বা বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় …

পিয়ানো –    স্থপতি হিসেবে নিজের অবস্থানটাকে যদি সৌভাগ্যক্রমে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় নিশ্চিত করা যায় , তাহলে হয়তো সেই ‘মৌলিক পরিবর্তনে’ আপনি কোন উপায়ে এবং কিভাবে ভূমিকা রেখেছেন তার সাক্ষী হতে পারবেন। কিন্তু সেটা সত্যিই খুব কঠিন ! কারন মানুষ প্রকৃতিগত ভাবেই পরিবর্তনকে সহজে মেনে নেয়না। একজন স্থপতি সমাজ এবং সভ্যতার  ক্রমপরিবর্তনের রকমটাকে স্থাপত্যের ভাষায় ব্যাখ্যা করেন। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের অন্তর্নিহিত যে শিল্প, তা সতত পরিবর্তনশীল। আমি কখনই এটা ভাবার মত দুরহংকারী হতে পারিনা যে স্থপতি হিসেবে আমি-ই সেই পরিবর্তনের সংঘটক । তবে যদি সমাজ ও তার জনগোষ্ঠীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে সময় ব্যয় করা হয়, তাহলে সেই পরিবর্তনের সাক্ষী এবং ব্যাখ্যাকার হয়ে ওঠা যায় ।

নগর ও নাগরিকদের সংগে ভাববিনিময় করে স্থাপত্য

ক্লেমেন্স – এ প্রসঙ্গে চলে আসে, আপনার প্রায় সব কাজই, যেমন , Center Pompidu, Nasher Sculpture Center, New York Times Building, Harvard Art Museum এবং Whitney Museum of Art, এ সবগুলো স্থাপনাই যার যার শহরের কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে অসাধারন ভাবে !

পিয়ানো –     সেটা হয়ত আমি ইতালিয়ান বলে ; একজন ইতালিয়ান হিসেবে আমি বেড়ে উঠেছি নগরের প্রান-স্পন্দনকে নিজের সত্ত্বায় ধারণ করে। আমার ভিতরে আজন্ম –প্রোথিত ধারনা, নগর হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে দালানগুলো একে অন্যের সাথে কথোপকথনে মগ্ন। একটি দালান এবং তার সামনের রাস্তাটার মধ্যেও  একটা সংলাপ চলতে থাকে, সেটা অভিগম্যতা বিষয়ক , নাগরিক জীবন – শৈলী বিষয়ক । শহুরে নাগরিক হচ্ছে সে-ই, যে সত্যিকার অর্থে একজন ‘ভদ্রলোক’ , ভব্য ব্যবহারকারী, সহ-নাগরিকদের সঙ্গে ভাগআভাগি করতে সম্মত এবং যোগাযোগ – সমৃদ্ধ । একটি স্থাপনাকেও ঠিক এরকম হতে হয়। নগর এবং নাগরিকদের সাথে তার ভাব বিনিময় হবে। এ ধরনের স্থাপত্যগুলো মানুষকে সমষ্টিগতভাবে নগরজীবন উপভোগের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ তৈরি করে দেয়।  অনেকে একসাথে কোন বিষয়ে কথা বলা, একধরনের সহনশীল মানসিকতার জন্ম দেয় যা নাগরিক জীবন যাপনের মূলমন্ত্র ।

ক্লেমেন্স – … আর আপনার করা স্থাপত্য গুলো সেটা কিভাবে সম্ভব করে তোলে ?

পিয়ানো –     যে কাজগুলোর কথা আপনি উল্লেখ করলেন, সেগুলো একধরনের ‘উড্ডীন -স্থাপত্য’। অর্থাৎ, এরা মূলে প্রোথিত, কিন্তু ভুমিতল থেকে এমনভাবে মুক্ত যার ফলে এদের তলদেশের ভিতর দিয়েও আলোর অবাধ প্রবেশ ঘটে এবং শহরের চলমান জীবনযাত্রার নিয়মের সাথে স্থাপনাটির আভ্যন্তরীন নিয়ম-নীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । দালানটাকে ভুমিতল থেকে উঁচুতে স্থাপন করার ফলে, নীচতলাটা যেন বাইরের উন্মুক্ত পরিবেশেরই ধারাবাহিকতা, অর্থাৎ দালানটির নিজস্ব জায়গাতেও ভুমি-সংলগ্ন অংশটায় নাগরিক জীবনের অবাধ চলাচল ঘটতে পারে ।

পিয়ানোর স্থাপত্য চর্চার ধরন, সমালোচনা এবং উপলব্ধি

ক্লেমেন্স  আপনার অফিসে যে দিকেই তাকাই প্রচুর মডেল এর ছড়াছড়ি। পুরো দালানের ক্ষুদ্রাকৃতি  প্রতিকৃতি  থেকে শুরু করে কাঠামোগত সুক্ষ নকশার বিশদ-প্রতিরূপ পর্যন্ত। গত এক দশকের স্থাপত্যচর্চায় থ্রি -ডি মডেলিং সফট-ওয়ের ব্যবহারের কথা বিবেচনায় নিলে এসব মডেল তৈরী করা কি এখনো জরুরি ?

পিয়ানো      ডিজাইন এর প্রথম দিকে এ ধরনের মডেল তৈরী করাটা অনেকটা মোটাদাগে স্কেচ করার মত। কম্পিউটারে  কাজ করতে গেলে কি করতে হবে তা আপনাকে নির্দিষ্ট ভাবে বলতে হবে; কোথা থেকে শুরু, কোথায় শেষ । আমি যখন নতুন একটা ধারণা  প্রকাশের জন্য  স্কেচ করতে বসি, তখন আমাকে নিশ্চিত ভাবে জানতে হয় না ছবিটা কোথা থেকে শুরু করতে হবে বা শেষ।  এ প্রক্রিয়াটা অনেকটাই উদ্দীপনা নিয়ন্ত্রিত , সহজাত ভাবে উদ্বুদ্ধ।  স্কেচ করাটা এই প্রাথমিক মডেল গুলো তৈরির মতই অপরিপক্কতা-গুন-সম্পন্ন।  একেবারে যথাযথ হতে হয়না  বলে এটা আপনাকে স্বাধীন হতে দেয়, বার বার পরিবর্তন করার সুযোগ দিয়ে।  কম্পিউটারে আপনাকে যথাযথই হতে হবে, যখন কারও পক্ষে  তা  হওয়া সম্ভব নয়।  কারণ ডিজাইন প্রক্রিয়াটা  একদম শুরু থেকেই  স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট  কোনো ব্যাপার নয়।  আর সেটা করতে চাইলে  কোনো একটা নির্দিষ্ট আকার বা আকৃতির ভিতরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার আশংকা থাকে।  তাই এই সব প্রাথমিক মডেল বা  স্কেচের গুরুত্ব অনেক।  তবে যেটা  সবসময় মনে রাখতে হবে, তা হল, একটা মডেল, পুরো ডিজাইনটার  একটা আংশিকভাব প্রকাশ করতে  পারে।  সত্যিকার অর্থে যে জায়গাটায় সমস্ত ব্যাপারটা সামগ্রিকভাবে দানা বাঁধতে  থাকে এবং ক্রমশ মূর্ত হয়ে ওঠে , তা হলো আপনার মনোজগত।  এমনকি, আয়তনের আনুপাতিক সুষমতা এবং যথাযথতা, এসব অত্যন্ত চাক্ষুস বৈশিষ্টগুলোর ক্ষেত্রেও এটা সত্য।  আসলে একজন স্থপতির পক্ষে সবচেয়ে মারাত্মক যে ভুলটি করার আশংকা থাকে তা হলো কোনো স্থাপনার ডিজাইনে আয়তনগত অসংগতি।

ক্লেমেন্স – বিরূপ সমালোচনা থেকে আপনি কিছু শিখতে পেরেছেন বলে কি আপনার মনে হয় ?

পিয়ানো –     এটা একটা ধাঁধাঁই বটে! স্থপতি হিসেবে কাজের নিজস্ব লক্ষ্যগুলোর দিকে মনোযোগী থাকতে হয়, কিন্তু পাশাপাশি অন্যদের মতামতও গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে।  নিতান্ত বাজে মতামতগুলো বাদ দিয়ে ভাল মতামত গুলোকে চিনতে পারাটা দুরূহ, কারন, অনেক সময় সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বরগুলো কোলাহলের ভিতরে হারিয়ে যায় , কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। স্থপতিদেরকে অনবরত শিখতে হয়। এটা একটা দীর্ঘ শিক্ষানবিশির জীবন । তাকে বহু বিচিত্র বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠতে হয়, সভ্য মানুষ হিসেবে, কিছু গড়ে তোলার কারিগর হিসেবে, এমনকি কাব্যেও !

ক্লেমেন্স – এ পর্যায়ে এসে, স্থাপত্য চর্চার কোন দিকটি আপনাকে উজ্জীবিত করে রাখে ?

পিয়ানো      উদ্দীপনার উৎসগুলো সবসময়ই নতুন ধরনের। প্রতিদিনই একেকটা নতুন অভিযানের মতো , কারন প্রতিটা নতুন কাজই তাই। যেন রবিনসন ক্রুসোর মতো প্রত্যেকবার নতুন একটা দ্বীপে অবতরন করে নতুনকে আবিষ্কার করি, জানি , এই চেনাজানার কোন শেষ নেই। স্থপতি হিসেবে নিজের কোন একটা কাজের প্রতি লোকের যে প্রতিক্রিয়া এবং ভাব বিনিময় , তা আমাকে গ্রহন করতে হবে। কিন্তু গ্রহন করার অর্থ এই নয় যে লোকে যা বলবে আমি তা-ই করবো । আমি সেটা বুঝতে চেষ্টা করবো । এটা স্থপতিদের মূল কাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটা ভাল স্থাপত্য একটা সুন্দর গল্পের মতো । যেন একটা কাহিনীর বর্ণনা । সে কারনে, একজন লেখক বা  চিত্রপরিচালক অথবা স্থপতি হওয়া খুব আলাদা কিছুনা। প্রয়োজন শুধু একটা ভালো গল্প এবং ভালো লেখার ক্ষমতা , এবং অবশ্যই এ- দুটোই।

(সংক্ষেপিত)

http://www.metropolismag.com/Point-of-View/July-2014/Q-A-Architect-Renzo-Piano/


About the Author:

Architect Moushumi Ahmed is the Proprietor & Principal Architect at IDEA and former Head, Dept.of Architecture, Bangladesh University.

Kazi Fariha Tasnim Richie is an architecture student of AIUB

ABOUT THE AUTHOR

ARTICLES BY THE AUTHOR

PEOPLE ALSO VIEW