বসতবাড়ি | চিঠি ৭| বিল অঞ্চলের ঘর বাড়ি

30 January, 2021 Total View: 55

Ancestral home of Utsha Zaman | Visualization and inking by B.M Tahammul Kabir & colouring by Ridwan Noor Nafis © CONTEXT

প্রিয় দাদাভাই,

একটা গল্প বলি তোমাকে। একটা গ্রামের গল্প, একটা বাড়ির গল্প আর আমাদের বুবুর গল্প।

প্রতিবছর ঈদ আসলে আমরা সবাই মিলে যেতাম আমাদের দাদা বাড়ী; চাচা চাচি ফুপা ফুপি সব কাজিনরা মিলে। গ্রামের নাম খলিসাদহ , পাবনার বনওয়ারী নগর এর একটি ছোট্ট গ্রাম। বাস থামতো বাজারে, সেখান থেকে ভেঙে যেতে হতো। যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে বড় বড় পুকুর। বাঁধটা  পার হলে একটি সরু মাটির রাস্তা যার ডানপাশে কচুরিপানায় ভরা একটি ঝিল ছিল।  একটু সামনে হাতের বামে আমাদের বাড়ির পুকুর। তারপরেই একটা দ্বীপের মতো জায়গায়  ছিল বুবুর বাড়ি।

বাড়িতে ঢোকার রাস্তাটি ছিল খুব মজার। এলোপাথাড়ি অনেকগুলো গাছ, সেগুলোর ফাঁক গলে ঢুকতে হতো বাড়ির সামনের উঠানে। এই উঠানের পাশেই ছিল বিস্তৃর্ণ “বড় বিল”। পাঠকাঠির বেড়ার পাশ দিয়ে মূল বাড়িতে ঢুকলে বামে পাকা ঘরটার বারান্দায়, হাতল চেয়ারে বসে থাকতেন আমার বুবু।

সবার আগে আমাদের কাজ ছিল বুকে জড়িয়ে ধরবার। অতি স্নেহে  আদর করে দিতেন বুবু। ডান পাশে ছিল দাদুর ঘর।  দাদু চলে গেছেন কিন্তু দাদুর ঘরটা রয়ে গেছে।  কাঠের ঘরে ছনের ছাদ।  মাঝখানে ছিল ভেতরের উঠান। উঠানের দাদুর ঘরের সামনের ডালিম গাছটা কিছুটা নুইয়ে থাকতো ঘরের বারান্দায়।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা হত রান্নাঘরে। রান্নাঘরটা ছিল বাড়ির উত্তরে। টালি  দেয়া ছাদ কালো হয়ে গিয়েছিল মাটির চুলার ধোঁয়াতে। সকালের নাস্তা শেষে শুরু হয়ে যেত আমাদের দুরন্তপনা। গ্রাম, ক্ষেত, বিল সব চষে বেড়াতাম।  বড় কাজিনরা হয়তো একসাথে বসে কার্ড খেলত।  মাঝে মাঝে এসে বুবুর কোলে  মাথা রাখলে বুবু  মাথার উকুন বেছে দিতেন, মাথায় উকুন থাকুক আর না থাকুক।

দুপুরে স্নান এর ব্যবস্থা হল বাইরের উঠানের তারাপাম্প। সেখানে গণগোসল। খাবার ঘরটা ছিল বাড়ির সবচেয়ে জমজমাট জায়গা। আড্ডা, খেলা, খাওয়া সব হতো এখানে। এই ঘরটার দক্ষিনে ছিল বারান্দা, বিলের পানি বারান্দা পর্যন্ত চলে আসতো।

সামনের বিলটার ছিল অদ্ভুত মজা।  বর্ষাকালে বাড়ির সামনে পর্যন্ত পানি, আবার শীতকালে দেখা যেত সরিষা। যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ সরিষার ক্ষেত। বিকালে সব বাচ্চা-কাচ্চা জড়ো হতাম বাড়ির পেছনের খোলা জায়গায়। কখনো ক্রিকেট আবার কখনো ফুটবল খেলা হতো। আমরা যারা বেশি ছোট ছিলাম, সুযোগ পেতাম না। আমরা বসে থাকতাম পাশের কুলবড়ই  গাছটিতে। কুল বড়ই গাছটি  বাঁকা হয়ে একদিকে নুইয়ে পরেছিল, তাই ওটাকে গ্যালারি হিসেবে ব্যবহার করা যেত।  বল করবার জন্য বলার কে পশ্চিমের দেবদারু বাগানের ভেতর থেকে দৌড়ে আসতে হতো।  সূর্য একটু হেলে গেলে, বুবু রাখালকে বলতেন গরুগুলোকে খামারে ঢুকাতে। আমরাও ঢুকে যেতাম ঘরে।

সন্ধ্যাবেলা রতনচুর মোটরসাইকেলে বসে বাজারে যেতাম। রাতের বেলায় আমাদের মধ্যে টানাটানি লাগতো কে শোবে বুবুর পাশে। বুবুর পাশে ঘুমানোর এক অদ্ভুত আনন্দ ছিল।  বুবুর শাড়ীর গন্ধ এখনো খুব করে মনে আছে।  মাঝে মাঝে উঠানে বসে বাড়ির সবাই আড্ডা দিত, সন্ধ্যার পর।  গান হত, অনেক পদের গল্প হতো। কখনো রাজনীতি নিয়ে গরম হয়ে যেত পরিবেশ। আবার কেউ গান গেয়ে উঠলেই গ্রামের  নিস্তব্ধতার সাথে সুর মিলিয়ে সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতো; কখনো ভূপেন, কখনো সন্ধ্যা আবার কখনো জগজিৎ সিং এর গজল।

অনেক কিছু বদলেছে  সময়ের সাথে। সেই মাটির রাস্তাটা এখন আর নেই।  নেই দাদুর সেই কাঠের ঘরটিও।  ডালিম গাছে এখন আর ডালিম ধরে কিনা জানিনা কুলবড়ই গাছটিও  হয়তো নুইয়ে পরেছিল অনেক, চলে গেছে সেও। অনেক পরিচিত মুখ হারিয়ে গেছে, কিন্তু এখনও গেলে সেই সময়গুলো শব্দ পাওয়া যায়, সেই স্নিগদ্ধতা অনুভব করা যায়। আর মাঝে মাঝে বুবুর শাড়ির গন্ধটা ভেসে আসে বাতাসে।

 ইতি

তোমার দাদা

(প্রেরক:  উৎস জামান )


অন্যান্য তথ্য:

বাড়ির ঠিকানা :মুন্সিবাড়ি, গ্রাম: খলিসাদহ; পোস্ট অফিস: বনওয়ারীনগর; উপজেলা: ফরিদপুর; জেলা:  পাবনা

দাদা ছিলেন পুলিশ অফিসার। ১৯৭১ সালের পাবনা সদরে থাকা বাড়িটা রাজাকাররা পুড়িয়ে দিলে দাদা তার বাবার ভিতায় বাড়ি করেন। পূর্ব দিকে একটা কাঠের ঘর দাদার আগেই বানানো ছিল। ১৯৪০ এদিকে বানানো হয়েছিল ঘরটি।  বাকি ঘরগুলো ছিল শুরুতে টিনের তৈরি। দক্ষিণের আধাপাকা ঘর যেটা এখনো আছে সেটা বানানো হয় ১৯৭৬ সালের দিকে। কাঠের ঘরটি ভেঙে ফেলা হয় ২০০০ সনের পরে। বাড়ি দক্ষিণে আছে বিল যেটাকে এলাকার মানুষ বড়  বিল নামেই চেনে। বিলে সারাবছর চাষ হয় বর্ষাকালে পানিতে ভরে যায়। পূর্বদিকের পুকুরে মাছ চাষ হয়, ওটা গৃহস্থালী কাজের জন্য ব্যবহার হয় না। পুকুরের পূর্বদিকে  বড় ভাইয়ের বাড়ি।  আগে এই এলাকায় অনেক দূর পর্যন্ত কোন বাড়িঘর ছিল না এখন পশ্চিম দিকে বসতি বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তর দিকে একটি ফলের বাগান ছিল, যেটা এখন আর নেই। উত্তরে জলা আছে একটা যেটা পাশের গ্রাম থেকে বাড়িটা আলাদা করেছে। শুরু থেকেই বাড়িতে কোন সীমানা বেড়া ছিল না এখনও নেই। গরু ছাগল ছিল, তার জন্য একটা গোয়ালঘর ছিল। পশ্চিম দিকে একটা দেবদারু গাছের বাগান ছিল, যেটা পাশে থেকে বাড়িটা আলাদা করেছে।


Visualization by B.M Tahammul Kabir © CONTEXT
Drawn by: Utsha Zaman & B.M Tahammul Kabir © CONTEXT
Visualization by B.M Tahammul Kabir © CONTEXT

Dearest Dada Bhai,

Today, let me tell you a heartfelt story of a beautiful village, a home and our “Bubu.”

Every year when Eid holidays approached, everyone, including my parents, uncles-aunts and cousins, would travel together by bus to this beautiful destination, our village Kholishadoho. The village is located in the Banwari Nagar of Pabna. The bus stoppage was at the village market, from there, the rest of the pathway had to be decided by vans. When the van approached the dam, one would find large ponds bordering both sides of the roadway. After crossing the dam, a narrow unpaved path, with a water-filled green canal at the right side, leads us to our very own pond at the left side. Beyond this pond, stands the homestead island of my Bubu.

This pathway beside our pond, leading towards the outer courtyard, is an exotic experience in itself. Random trees right in the middle created a meandering pathway leading right to the outer courtyard. There is a wide, endless “Boro Bil” just beside this courtyard. Crossing the fence at its’ edge, one would enter the inner courtyard premises and used to find my Bubu sitting in her favorite wooden armchair, at the verandah of her semi pucca house. At the very first sight, we used to run towards Bubu and wrap our arms around her. She used to embrace us affectionately.

On the right side, stands our Grandfather’s home. Though he passed away many years back, his home stood there just as before. Wooden walls with a thatched roof and the inner courtyard, at its’ centre. In front of his home, there used to be a pomegranate tree, with its branches sagging towards the verandah.

Every morning, we used to have breakfast in the kitchen, located at the north of the courtyard. The clay-tiled roof above has blackened by the smoke from the clay stove. After breakfast, we used to run around wildly, at every nook and corner of the village area, while the elder cousins used to gather and play cards. Sometimes, when we used to rest our heads in Bubu’s lap, she would run her fingers through our hair as if looking for lice, despite we had it or not.

Every afternoon, we used to bathe together using the tube well, at the outer courtyard corner. On the other hand, the dining room was everyone’s all-time favourite gathering space. We used to laugh, share stories while having meals together and watching the verandah, at the south of the dining space, getting drenched with the water from the nearby ‘Boro Bil.’ ‘Boro Bil” has a story of its own; a marshy land that brims with water in the rainy season and again is filled with an endless horizon of the yellow mustard blanket, in every winter.

Every late afternoon, the kids used to gather in the backyard for playing football and cricket. For proper throwing, the bowler used to run a long-distance through the Debdaru garden, at the west. Some of us, who were very young, were just a spectator to the game amongst the elders. We used to enjoy the game sitting at the branch of the drooping plum tree rooted nearby. When the sun would almost set, Bubu would ask the shepherd to take the cows back inside their sheds and we would head back inside home.

Every evening, we would visit the village market, riding in Roton Uncle’s motorbike. The journey itself was exhilarating. And every night we used to fight over who would sleep next to Bubu. While sleeping peacefully beside her, I can still recall the beautiful scent of her saree. At times, the elders would gather around the courtyard in the evening. They used to sing, share stories amicably and even discuss politics, heating the atmosphere with arguments at times momentarily. Again, at the end, someone’s musical voice would turn the ambiance magical, with Bhupen’s, Shondha’s, and Jagjit Singh’s ghazals.

Now, everything has changed over period of time. That unpaved pathway, grandfather’s wooden home no longer exists. Maybe the pomegranate tree no longer bears fruits, the drooping plum tree has disappeared altogether. Many known faces have faded and disappeared with time. But even today, when I visit, I can hear the laughter, songs in the silence… I can feel Bubu’s saree’s scent in the wind.

With Love,

Your Loving Grandpa

(sender: Utsha Zaman)


হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।

আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।

বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/

ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com


Disclaimer:

CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website.

PEOPLE ALSO VIEW