মূল চিঠি:
প্রিয় দাদুভাই,
একটা পুরনো দিনের গল্প বলি শোনো। মফস্বলগুলোর গা থেকে তখনো গ্রাম গ্রাম গন্ধ যায়নি। এতো আলো ঝলমল খাবার দোকান, শপিং মল ছিলো স্বপ্নের মত। তখনকার কথা বলছি। পরিবর্তনের শুরুর দিকটা, গ্রাম থেকে লোকজন সবে শহরে এসে ইট কাঠের বাড়িঘর করছেন, সেসব বাড়িতে রয়ে যাচ্ছে গ্রামের উঠান, রোয়াক, কলতলা, তাল-সুপুরি গাছের সারি, আর নকশাকাটা জানলা গলে কমলা রঙের রোদ।
আমার বেড়ে ওঠাও উত্তরবাংলার অমন একটা গাছপালা ঘেরা ছায়া ছায়া দোতলা বাড়িতে। হলুদ রঙের বড় ফটকে চিঠি ফেলার ঘর, সেই ফটক পেরিয়ে ঢুকতেই ডানে একটা কলপাড়। মনে আছে ওই কলতলায় ইট দিয়ে ঘসে ঘসে তাঁর বাচ্চাদের গোসল করাতেন দুখাই খালা। বাঁ দিকে বড়সড় গ্যারেজ, গ্যারাজের ওপরতলাটা ফেলে রাখা, রান্নার বড়সড় খড়িগুলো রাখা হতো কেবল সেখানে। আর আমাদের ছোটদের কাছে সেটা ছিলো ভূতের বাড়ি খেলার জায়গা। গ্যারাজের পাশে উঁচু নারকেল গাছ, তার পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের ঘরটায়। সেই সিঁড়ি আমার জন্য এতো বড় ছিলো সেসময়, যে এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে উঠতাম রীতিমত হাঁচড়ে পাঁচড়ে – থ্রিলিং ছিলো বটে ব্যাপারটা। আবার গ্যারেজের উপরকার কার্নিশ ধরে হেঁটে রান্নাঘরের বারান্দায় লাফ দিয়ে চলে যাওয়া যেতো। কী থ্রিল উফফ! ছোটমানুষ ফাঁকা দিয়ে টুপ করে নিচে পড়ে গেলে কী হত তাই ভাবি এখন।
নিচতলার হলরুমে সরাসরি যাওয়া যেতো, কাছারিঘর যেমন থাকে গ্রামে। বাচ্চকাচ্চাদের জন্মদিন, দাদার বিয়ে সব এখানেই হয়েছিলো। আর অন্দরে আসতে হলে আলাদা দরজা, পাঁচিল দেয়া। দোর পেরোলে আবার উঠান, তাতে প্রকান্ড এক তেজপাতা গাছ। লম্বা হয়ে দশ বারো ফিট উঠে কান্ড দু’দিকে ছড়িয়ে গেছে। পেছনদিকে সার ধরে সুপুরির গাছ, দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বিরাট কাঁঠাল গাছ শেকড় ছড়িয়ে আস্তানা গেড়েছিলো বাড়ির ভিত পর্যন্ত। প্রতিবার আম কাঁঠালের মৌসুমে মাটির নিচে কাঁঠাল পেকে সুবাস বয়ে নিয়ে বেড়াতো পুরো বাড়ি – সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’ যদি তোমার পড়া থাকো, তবে এই অনুভূতিটার সাথে হয়তো পরিচয় থাকবে। ওদিকে পাঁচিল পেরিয়ে অন্য মাঠের ওপরকার আতা গাছ ফল নিবেদন করছে দক্ষিণ বারান্দায়। দক্ষিণে বড় মাঠ। বৃষ্টি হলে সেই মাঠ পুকুর হয়ে যায়।
আমার নানুর বারান্দাপ্রীতি ছিলো প্রবল। দোতলায় ঝুলবারান্দা ছিলো একটা, সামনের বাসার বন্ধু ওহীদের ছাদ আর উঠান দেখা যেতো এখান থেকে। গাড়ি দেখা যায় এই কারণে নাম গাড়ি বারান্দা কিনা জানিনা, তবে বিকেল হলে খালামণিরা ও বাড়ির মহিলাদের হাই-হ্যালো করতে পারতেন, আর আমরা বড়সড় খোলা জায়গায় সারাদিন গাড়ি গাড়ি খেলতে পারতাম। দশ ফুট মত চওড়া বারান্দা পুরো বাড়ি জুড়ে, সেখানে ভরদুপুরবেলা ধুপধাপ বল পিটিয়ে ক্রিকেট খেলতো খালাতো ভাই আর মামারা, মাঝেমাঝে বল ছুটে পাশের কারো বাড়িতে গিয়ে পড়তো, সেই বল উদ্ধার করা ছিলো কষ্টসাধ্য ব্যাপার!
পুরো বাড়িতে রান্নাঘর-বাথরুম মিলিয়ে ২৪টা ঘর। নিচতলা আর দোতলার আলাদা রান্নাঘর, দোতলার রান্নাঘরে যাবার জন্য ছোট্ট ব্রিজ। একবার রান্নাঘরের মুখে ব্রিজের ওপর দাঁড়াতেই বৃষ্টি নামলো। ব্রিজের পাশে পায়রার খোপ, পায়রাগুলো উড়ে এসে চাল খাচ্ছিলো ব্রিজে নেমে, বৃষ্টির আভাস পেয়ে সব উড়ে পালালো ঘরের দিকে, আমি দেখলাম একটা একটা করে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা কেমন নেমে আসে আকাশ থেকে, তপ্ত মেঝেয় পড়ে কেমন মিলিয়ে যায়, আর তার সাথে মেঝে থেকে ভাপ দিয়ে ওঠে একটা সোঁদা গন্ধ। ছোটবেলায় কবিতা পড়েছিলাম, “চৈতি রোদে পোড়া মাটি বৃষ্টি ভিজে গন্ধ খাঁটি“, সেই কবিতা আবৃত্তি করার সময় এই গন্ধটার কথা আমি ভাবতাম।
মনে আছে ওবাড়ির বাথরুমে যেতে আমি হালকা ভয় পেতাম। দুপুর গড়ালে বড় গোসলখানার ঘুলঘুলি গলে মরে যাওয়া রোদ বড় বড় নকশা তৈরি করতো মেঝেতে, জানিনা কেন আমার একা যেতে অনেক মন খারাপ হতো সেখানে। এরকম মন খারাপ হয়েছিলো শেষবার ঐ বাড়ি থেকে চলে আসার দিন। বাকসো প্যাঁটরা বাঁধা ছাদা হচ্ছে, আমি দোতলার বারান্দায় ঘুরঘুর করছি একা, হঠাৎ খাবার ঘরের জানালা দিয়ে কমলা আলোর বিপরীতে একটা সুপারি গাছের কালো ছায়া দেখে খুব মন কেমন করে উঠলো। কেন হলো জানি না, তবে ওই মন কেমনটা অনেকদিন একঘেয়ে অসুখের মত রয়ে গেছিলো আমার সাথে।
এখন, ওই চব্বিশটা ঘরে, আমার পুরনো ঘুমানোর জায়গায় কাগজের তাড়া, অফিসঘর। ম্যাড়ম্যাড়ে হলুদ আলোর নিচে ওষুধের আড়ত করা হয়েছে। লাল লাল গ্রিল বসেছে বারান্দার ওপর। পায়রার খোপটা বোধহয় এখন আর নেই, নিচতলার রান্নাঘরটা আছে। সাগরের নিচে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের মত পুরনো আসবাব, চুলা, থালাবাটি সমেত অমনই তালা দেয়া আছে এখনো। কালের ধূলো জমে জমে পুরু হয়ে গেছে এতোদিনে, কিন্তু তোমার পুর্বসূরীর মায়া মেখে ওই বিশাল একা বাড়িটায় মায়াপুরীর মত ঘুমিয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া একটা কাল।
ইতি,
তোমার দিদামণি।
প্রেরক: নোশিন তুবা
বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা: এ কে এম নজরুল ইসলাম চৌধুরী (লেখিকার নানা)
পেশাঃ তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (আয়কর), রংপুর জেলা
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৭৬
(English Version)
Dear Grandchild,
Let me take you on a trip of an old time when the essence of the country sides had not yet faded away from the suburbs. All these illuminated food shops, shopping malls were like a dream back then. The time I’m talking about, is the beginning of the transition – when people from the villages had just come to the city and started building brick or wooden houses, and like the villages, there remained the courtyard, royak (front veranda), kaltala (tubewell), rows of palm and betel nut trees and the tangerine sunlight melting through the carved windows.
I also grew up in such a calm, shadowy two-storied house of North Bengal, surrounded by trees and greeneries. There was a letter-box on the large yellow gate, a tubewell on the right side as you enter through that. I remember, Dukhai aunt used to bathe her children there by rubbing burnt pieces of bricks on their body. A large garage on the left, leaving the upper floor only for storing charcoals and firewoods. And for the little ones like me, it was a place for playing ‘haunted house’. There was a tall coconut tree next to the garage, with a staircase leading up to the upper room. That staircase was so big for me that time that I literally had to crawl up to climb from one step to the next – a very thrilling stuff I’d say. Again, we could walk along the cornice on the top of the garage and jump on the kitchen porch from there. What a thrill! Now I wonder, what would have happened if someone had fallen down from that height in the gap between the garage and the kitchen.
The hall room on the ground floor could be accessed directly from the entry, just like the ‘Kachari Ghar’ (meeting room) in the village houses. The children’s birthdays, Dada(eldest cousin)’s wedding – all took place here. One need to use a separate door to enter the more restricted inner house. After the door there was the courtyard, and a huge Bay leaf tree in it. The stem grew like ten to twelve feet tall then got divided into two sides. There were rows of betel nut trees in the back, a huge jackfruit tree in the south-east corner – spreading its roots to the foundation of the house. Every time in the summer season, the whole house used to get filled with the aroma of ripe jackfruit underneath the ground – If you have read the book ‘Uttaradhikar‘ by Samaresh Majumder, you may be familiar with this feeling. On the other hand, from another field after the wall, was a Cassava tree offering fruits on our south veranda. A large field was there to the south. When it rained, the field used to turn into a pond.
My grandfather had an immense weakness for verandas. There was a hanging balcony on the first floor, the roof and courtyard of my mate Ohee’s house in front could be seen from here. I don’t know why this balcony was called ‘Gari Baranda (Car Veranda!)’, if that was because we could see cars from there or anything else, but in the afternoon our aunts could do some hi-hello to the next-door ladies, and we could pretend play like driving a car all day long in that big open space. Another nearly ten-feet-wide veranda was there around the whole house, where my cousins and uncles used to play cricket at the noon – sometimes the ball bounced off to someone’s house next door, it was really tough to get it back from them!
The whole house had 24 rooms in total including the kitchens and bathrooms. There were separate kitchens for the downstairs and the first floor, and a small bridge to go to the kitchen upstairs. One day, while standing on the bridge, it started raining. Beside the bridge was a pigeons’ nest, the pigeons were nibbling grains down the bridge, all of them flew away towards their house just the moment they got a hint of the rain. I saw how one by one big drops of rain came down from the sky, how it fell on the heated floor and got dried up and evaporated, leaving a unique, earthly smell. I read a poem in my childhood, “Chaity rowde pora mati/ bristi bhije gondho khanti (The earth burnt in the scorching sun of the month Chaitra, leaves a pure smell from there after it rains)”, while reciting that poem, I used to think of this scent.
I remember, I was a little scared to go to the bathroom of that house. As the noon passed, the dying light of the day filtering through the ventilators used to cast long shadow on the floor. I don’t know why it made me feel so empty to go there alone. The last time I felt this sadness was the day we were leaving that house. While my parents were packing up the bag and baggage, and I was wandering alone on the veranda upstairs. Suddenly looking at a silhouette of a betel nut tree against the orange sunlight through the dining window made me feel somewhat ineffable – I don’t know why, but somehow that emptiness remained with me like a monotonous malady for a long time.
Now, in those twenty-four rooms, in my old sleeping place, there are all bunches of papers, office rooms. Medicine lots have been stored under dead, yellow lights. Red grilles have been set on those large open verandas. The pigeons’ nest is probably no more there, the kitchen downstairs is still kept like that. Like the Titanic that sank under the sea – still locked with the old furniture, stove and the dishes inside. The dust of time has thickened and thickened so far, but carrying all the mesmerism of your predecessor, there sleeps a long lost time in that huge lonely house, like a timeworn castle.
Love,
Your Granny.
Author: Noshin Tuba
Founder: A.K.M Nazrul Islam Chowdhury (Author’s Grandfather)
House Established in 1976
হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।
আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।
বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/
ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com
Disclaimer:
CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website.