মূল চিঠি:
স্নেহের দাদুভাই,
আজ তোমাকে এক স্বপ্নপুরীর গল্প শোনাবো।এটা কোনো কল্পপুরীর গল্প নয় বরং বাস্তবের এক স্বপ্নপুরীর গল্প, এক সবুজপুরীর গল্প। এই চিঠিতে সেই বর্ণনাই তোমার জন্য লিখছি।
আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে সবুজ বেষ্টনীতে ঘেরা বসতির সবুজাভ আলো আর মাটির সোঁদা গন্ধ মেখে। বিশেষ করে আমার নানাবাড়িতে সেই রকমই এক আবহ সবসময় মনকে মাতিয়ে রাখত।শৈশবের সব স্মৃতিই এ বাড়িতে লেপ্টে আছে।সবুজপুরীর গল্প মূলত সেই নানাবাড়িকেই ঘিরে।
আমার নানার বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার সদরদী নামক এক নিভৃত গ্রামে।প্রকৃতিকে এখানে রূপের পসরা নিয়ে বসতে দেখেছি রোজ; বেলা কিংবা অবেলায়, দিনে কিংবা রাতে।ঋতুবৈচিত্র্যে তখন এতটা খামখেয়ালিপনা ছিলনা।তাইতো বাড়ির আঙিনা জুড়ে খেলা করত ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য।
বসতবাড়িটি একটা উঠানকে কেন্দ্র করে করা।তার চারপাশ ঘিরে সাজানো হয়েছে ঘরগুলোকে।মূল উঠান ছাড়াও আরও কিছু ছোট ছোট উঠানআর কয়েকটা বাগান নিয়ে মলত গুচ্ছ আকারে করা পুরো বাড়িটি। মূল ঘরের পাশাপাশি অতিথিদের থাকবার ঘর, বৈঠকখানা, রান্নাঘর, গোসলখানা, টয়লেট ও কলপাড় সংলগ্ন একটি ছোট্ট চৌবাচ্চা ছিল।ঘরের দেওয়ালগুলো ছিল টিনের তৈরি, দরজা ও ছোট ছোট জানালা কাঠের তৈরি।এর এক পাশের দেওয়ালের সাথে লাগোয়া বারান্দা ছিল।পাকা মেঝের কাঠের খুঁটির উপর ছিল চৌচালা ছাদ।সিলিং ছিল কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো।শুধুমাত্র রান্নাঘরের দেওয়ালগুলো পাটখড়ি আর শেড হিসেবে টালি ব্যবহার করা হয়েছিল আর মেঝে ছিল মাটির তৈরি। রান্নাঘরের সামনে কিছুটা খোলা জায়গা ছিল যেখানে রোজ সকাল-বিকাল চায়ের আড্ডা জমতো।শীতের দিনে এখানেই সবাই ভীড় করতাম পিঠা-পুলির লোভে।এছাড়াও পাকা পোতা আছে যেগুলোতে এখন কোন ঘর নেই, ফাঁকা পড়ে আছে (পোতা বলতে সাধারণত ঘরের প্লিন্থ লেভেলকে বুঝানো হয়)।পোতাগুলোতে কাপড় শুকাতে দিত কিংবা বিভিন্ন রকম মজাদার আচার রোদে দেওয়া হত।শীতের সকালে এখানে মাদুর বিছিয়ে আয়েশ করে সবাই রোদ পোহাতাম।
বৃষ্টির সময় এ বাড়ির চিত্র আরেক রকম।টিনের চালে বৃষ্টির অবারিত সুরধারা কিংবা শিলাবৃষ্টির টুংটাং শব্দ যেন এক অন্য জগতের, অন্য পরিবেশের আবেশ ছড়ায়।ব্যাঙের দেখা মিলতো উঠানে,সিঁড়িতে কিংবা বারান্দায়।এসময় এক ঘর হতে অন্য ঘরে যাওয়ার জন্য ইট বিছানো পায়ে হাঁটা পথ ব্যবহার করতে হত।
সবচেয়ে বিস্ময়কর লাগে এ বাড়ির অসংখ্য সারি সারি গাছ আর হরেক রকম ফুলের সমারোহ দেখে।ঘরের সিঁড়ির দু’পাশে দুটো হাসনাহেনা গাছ লাগানো।বর্ষাকালে হাসনাহেনার ফুলের সুগন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে পড়তো।উঠানের এক কোণে ছিল কদম ফুলের গাছ আর বাগানে রয়েছে আম, ডালিম, পেয়ারা, জামরুল, কাঁঠাল, সফেদা, মেহগনি, নারকেল কিংবা সুপারি গাছের সমারোহ।উঠানের বড় সফেদা গাছের ডালের সাথে ঝুলানো ছিল একটা ছোট দোলনা।বাড়ির পূর্ব দিকে একটা পুকুর ছিল। সেখানে প্রায়ই ডাহুক পাখির দেখা পাওয়া যেত।মাঝেমাঝে গড়িয়ালের দেখা মিলতো বলে পুকুরটিতে সচরাচর কেউ যেতাম না।পুকরের আশপাশ ঘিরে ছিল সুপারি গাছ আর বেতের ঝোপ।
সেখানে বিদ্যুৎ ছিলো না কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই উঠানজুড়ে নামতো অসংখ্য জোনাকি।মনে হতো আকাশ থেকে উঠানটায় সব তারা নেমে এসেছে।বাঁশঝাড় আর ঝোপের আড়ালে থাকা ঝিঁঝিঁ পোঁকার বিরামহীন শব্দ এক ঘোরলাগা অনুভূতির সৃষ্টি করত।সে সময় ঘরে মাদুর বিছিয়ে হারিকেনের আবছা আলোয় মুরব্বিদের কাছে শোনা হাজার রূপকথার গল্প যেন আমরা সত্যি সত্যি অনুভব করতাম।
অকৃত্রিম এ ভালো লাগার পরিবেশ সময়ের অগোচরে হারিয়ে গেছে।মাটি আর সবুজের ঘ্রাণ মানুষের মধ্যে যে প্রাণের সঞ্চার করে-তা ভুলতে বসেছি সবাই।অথচ প্রকৃতিকে লালন করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।আশা করি তুমি এর মর্ম অনুধাবন করবে।
ইতি,
তোমার দিদা
প্রেরক: হোসনে আরা লিজা
অন্যান্য তথ্য:
এলাকার নামঃ ফরিদপুর
পূর্বপুরুষের তথ্য: মরহুম হাজী মোকাদ্দেছ হোসেন মোল্লা, গ্রামঃ সদরদী, জেলাঃ ফরিদপুর ।
এথনিসিটি:বাঙালী
নির্মাণকাল: ১৯৭৭ সাল
ভেঙ্গে ফেলার সময়ঃ ২০১২ সাল
English Version| Translated by: Mahin Haque
My dear dadubhai,
Today, I shall tell you the story of a magical wonderland. Surprised? Well, you should be. But remember, it’s not an imaginary fictional world as you see in the fairytales. Rather, it’s quite real. This is the story of an enchanted world that used to exist. It was my home, my beautiful green paradise.
In this letter, I’m going to write to you about this forgotten world, so that the memories live on.
I spent my childhood and grew up in my maternal grandparents’ ancestral home, which was surrounded by greeneries all around. I can still remember the golden sunlight passing through the green canopies and branches overhead; with a wonderful greenish hue. I can still smell the fresh soil and wet earth beneath my feet. The very atmosphere had a unique homely flavor to it, which captivated my young mind. All the memories of my childhood belong to that special house. And yes, the story of the ‘green paradise’ basically revolves around it.
My grandparents’ house was located in a secluded village called Sadardi in Faridpur district. There, each day nature presented itself with different shades of beauty in different season and time of the year. It was the era when seasons were not so unpredictable like now; so the variety of beauty of the six seasons could be overwhelmingly felt and observed all over the yard.
The main house was centered around an inner courtyard; with different sections of the house arranged around it. The whole house was built in a cluster system; and in addition to the main yard, there were several additional courtyards and also few gardens connected to the central premise. Along with the main house, there were guest rooms, living room, kitchen, bathroom, toilet and a small bathtub adjacent to the tube well area. The walls of the house were made of tin; and the doors and small-sized windows were made of wood. It also had an adjoining verandah with a side wall. The chauchala roof was supported by wooden pillars on the paved floor; and the ceiling was made of wooden planks. Only the walls of the kitchen were made of jute-stick, while the overhead shed was made of tali, and the floor was made of clay.
There was a little open space in front of the kitchen where we used to have tea every morning and afternoon. During winter days, we all used to gather here and wait for pitha-puli while my grandma prepared them in the kitchen. Also, there were a few raised plinths (known as paka pota) here and there, which were basically empty spaces on raised platforms without any house or shade over them. These were used for drying clothes as well as drying variety of tasty jams and pickles. In the winter morning, we used to sit on the mat and relax here while enjoying the sun.
During rainy season or monsoon, the picture of the house became quite different. The uninterrupted melody of rain on the tin roof or the tung-tang sound of hailstorm seemed to create a surreal atmosphere inside the house. It felt like a different heavenly environment; a different living and breathing world! Frogs could be seen in the yard, on the stairs or on the verandah during rain. At that time, brick pedestrians were used in the yard to move from one part of the house to another.
The most amazing thing was to see the innumerable rows of trees and all kinds of flowers around the house. There were two hasnahena trees on either side of the stairs. In the rainy season, the sweet fragrance of those beautiful flowers would spread around the house. In one corner of the yard, there was a kadam tree, and in the garden there were mango, pomegranate, guava, jamrul, jackfruit, sofeda, mahogany, coconut, and betel trees. There was a small swing hanging from the branches of a big sofeda tree in the yard. There was also a small pond on the east side of the house. Dahuk birds were often seen there. We didn’t usually go to the pond because crocodiles could be seen roaming around the pond from time to time. The pond was surrounded by betel trees and cane bushes.
There was no electricity available, but in the evening countless fireflies started to roam and fly all over the yard. It was as if all the stars had fallen from the sky and came to inhabit our home. There was also the incessant sound of crickets behind bamboo bushes which definitely made one feel dizzy and light-headed. At that time, in the dim light of the hurricane, we used to spread mats on the floor and sat around the elders, and listen to thousands of fairytales and stories. It used to be such an ethereal experience for us, as all the characters of the fables and fairytales became somewhat real; and we could almost feel their presence around us.
To be honest, this unadulterated environment of feeling good has been lost over the flow of time. We almost forgot how the raw smell of soil and greenery breathes life into human beings; how it makes us alive. But the fact is, it is our responsibility to nurture the nature, so that it becomes more sustainable. And not to mention, our very life depends on it. I hope one day you will understand the true meaning of it all.
No more today, dear one.
Yours,
Beloved dida
হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।
আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।
বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/
ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com
Disclaimer:
CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website.