মূল চিঠি:
প্রিয় দাদাভাই,
কেমন কাটছে তোমার শহুরে জীবন? তোমার কি জানতে ইচ্ছা করে কেমন ছিল আমার গ্রামের বাড়ি? আজ তোমাকে বলব আমার সেই মাধুর্যময় ছোটবেলার কথা।
সারাবছর অপেক্ষার পর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আসত সেই আকাঙ্ক্ষিত ছুটি। ব্যাগ-বস্তা গুছিয়ে পরিবারসহ রওনা হয়ে যেতাম গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পটুয়াখালী জেলার বড়বিঘাই ইউনিয়নের সাইচাবুনিয়া গ্রাম। বাসে করে লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে দিতে দুপাশের ছড়ানো ধানক্ষেত আর পদ্মবিল দেখত দেখতে স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। বাস থেকে নেমে নসিমন নামের এক বিশেষ গাড়ী, তারপর ট্রলার, সবশেষে পায়ে হেঁটে যখন নানুবাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছুতাম তখন গভীর রাত। ল্যাম্পুর টিমটিমে আলোয় নানীজানের রান্না করা ঝাল ঝাল তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে কাঁথা বিছানো নরম বিছানায় লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পরতাম।
সকালে ঘুম ভাঙত কবুতরের গম্ভীর বাকবাকুম ডাকে। সেই কাকডাকা ভোরে সবাই উঠে পড়ত। পুরো বাড়ি মানুষের আওয়াজে গমগম করত। নানী আর মামীরা রান্নাঘর কাজে লেগে যেতেন। মামারা উঠানের সামনের সবজি ক্ষেতের যত্ন নিতেন। আগাছা পরিষ্কার আর পানি দিয়ে ডালা ভর্তি তাজা সবজি নিয়ে ফেরত আসতেন। মামাতো ভাইরা গরু ছাগল নিয়ে যেত মাঠে। ততক্ষণে কুয়াশা ফুঁড়ে রোদ এসে উঁকি দিত। নানীজান ডাক দিতেন নাস্তার জন্য। রান্নাঘরের সামনে খোলা বারান্দায় নরম রোদের মধ্যে পাটি বিছিয়ে খেতে বসতাম। নতুন চালের ভাপা, পুলি, পাটিসাপটা হরেক রকম পিঠা থাকত। কখনো থাকত সেই তাজা সবজি দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি, কখনো আবার গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে কয়লায় পোড়ানো বেগুন ভর্তা আর শুকনো মরিচ। বেলা বাড়লে মামাতো ভাইয়েরা হইচই করে পুকুরে মাছ ধরতে নামত। আর আমি বোনদের সাথে সেই মাছ কুড়িয়ে টুকরিতে নিতাম। দুপুরে রান্না করা তাজা মাছের সেই স্বাদের কোন তুলনা হয় না। মাঝেমধ্যে ভাইরা কলাগাছ কেটে ভেলা বানিয়ে দিত। আমরা সেই ভেলা বাকিয়ে পুকুরজুড়ে ঘুরে বেড়াতাম। বিকাল বেলা উঠানে খেলা শুরু হতো। কানামাছি, গোল্লাছুট, বৌ-চার খেলতে খেলতে সন্ধ্যা। ইলেক্ট্রিসিটি না থাকায় সন্ধ্যা হলেই গাঢ় অন্ধকার চেপে বসত। ল্যাম্প আর হারিকেনের আলোয় সেই অন্ধকার দূর হত না। শীত কমাতে সবাই চুলার আগুন ঘিরে বসে গল্প করত। মাঝেমধ্যে বড়মামা ভূতের গল্প জুড়তেন। সেই রোহমর্ষক গল্প শুনে ছোট থেকে বড় সবার গায়ে কাটা দিয়ে উঠত।
নানুবাড়ির সামনে ছিল বিশাল উঠান, তার পাশে ছিল ইয়া বড় পুকুর। উঠানের সামনে একদিকে সবজীক্ষেত আর একদিকে বড় গাছের বাগান। সেই বাগানে দিনের বেলাতেও আলো ঢুকতো না ঠিক করে। নানা ভুতপ্রেতের কাহিনী ছিল সেই বাগান জুড়ে। সেই ভিটেবাড়ির চারপাশজুড়ে আদিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। শীতের সকালে কুয়াশা মোড়ানো সেই পাকারঙ্গা ধানক্ষেত দেখে মনে হত কেউ বুঝি মাঠ জুড়ে সোনা বিছিয়ে রেখেছে।
গ্রামের শীতের সকালগুলো একেকদিন একেক রকম হত। কোনদিন সকালে উঠে দেখতাম ধান কাটার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কাটা ধান আঁটি বেঁধে মাথায় করে এনে উঠানে টালি করে রাখা হচ্ছে। পরদিন হয়তো ঘুম ভাঙত ধান মাড়াইয়ের শব্দে। মামীরা পুকুরপাড়ে সেই ধান উড়াতেন। কোনদিন সকালে আবার সেই ধান সিদ্ধ করে দেওয়া হত। সিদ্ধধান ছড়িয়ে দিলে তারমধ্যে গুপ্তধনের মত পাওয়া যেত কলাপাতায় মোড়ানো ধান-ভাপা পিঠা। খেজুর রসে ভিজিয়ে সেই পিঠা খেতে কিযে মজা !
এমনি করে দেখতে দেখতে কিভাবে যেন ছুটি শেষ হয়ে যেত। সেই সুন্দর মায়াবী গ্রামগুলো এখন আর নেই। ইলেক্ট্রিসিটির আলোয় তারাভরা উজ্জ্বল আকাশ অথবা ভরা জ্যোৎস্নার আলোআঁধারি কোনটাই উপভোগ করা যায় না। আধুনিক এই প্রযুক্তিগত সভ্যতার সাথে সাথে সেই প্রাকৃতিক প্রাচুর্যও ফেরত আসা দরকার। তোমাদের প্রজন্মই হয়তো সেই গুরুদায়িত্ব কাধে নেবে এই আশা করি।
ইতি
তোমার দাদিমা
নামঃ নাবিলা নার্গিস
পেশাঃ ছাত্রী
বয়সঃ ২৩
এলাকাঃ পটুয়াখালী জেলার বড়বিধাই ইউনিয়নের সাইচাবুনিয়া গ্রাম
এথনিসিটিঃ বাঙালী
বাড়ীর ম্যাটেরিয়ালসঃ মাটি, কাঠ, বাশ, খড়, গাছের খুটি।
নির্মানকালঃ প্রায় ১৫০ বছর আগে।
English version | Translated by Noshin Tuba
Dear Dadabhai,
How is your city life going? Do you ever wish to know how my village house was? Today I will share the tales of my sweet childhood with you.
After waiting all year, at the end of the annual exams those long-awaited holidays used to come. I packed my bag and baggage and left with my family for our village home – Saichabunia village of Barabighai union in Patuakhali district. Throughout the journey on the road by bus, I used to get lost in the realm of dreams seeing the paddy fields and lotus ponds on both sides of the road. On a special vehicle named ‘Nasimon’ after getting off the bus, then on a trawler, finally on foot when we reached the doorstep of my grandma’s place, it happened to be the in middle of the night. Having our supper in a dim gleam of lamp with rice and hot-spicy curry cooked by Nanijan (grandmother), we fell asleep on the soft warm bed covered up with the warm blanket.
We woke up to the coo of the pigeon every dawn. Everybody used to get up that cockcrow in the morning. The whole house remained filled with the resonance of the peoples’ voices. Grandmother and aunts got engaged with cooking stuff. Uncles used to take care of the vegetable field in front of the yard. They watered the plants, cleaned up the weeds and used to come back with baskets full of fresh vegetables. My cousins used to take the cows and goats to the field for grazing. By that time the sun peeked through the fog. Nanijan used to call us for breakfast. We sat for our breakfast on a mat on the veranda in front of the kitchen, beneath the soft sunlight. There used to be Vapa, Puli, Patisapta and many more pithas (sorts of local cakes) made of new rice. Sometimes there was ‘khichuri’ (hotchpotch) cooked with fresh vegetables, sometimes there were smoky-hot steamed rice with mashed brinjal burnt on charcoal and dried chilies. As the day progressed, my brothers used to go fishing in the pond. And I used to pick up the fishes and put those in the basket with my sisters. There is no comparison to the taste of those fresh fishes cooked at noon. Sometimes my brothers used to cut banana trees and make rafts. We floated all around the pond on that raft. In the afternoon the games started in the yard. It usually would be evening playing Kanamachi, Gollachhut, Bou-chor, etc. As there was no electricity back then, no sooner had it fallen dusk than it became very dark all around. Lamps and hurricanes could not cease that darkness. To reduce the cold, everyone used to sit around the stove and chitchat. Sometimes my uncle used to yarn ghost stories. Hearing those thrilling stories, everyone from the youngest to the oldest used to come up with shivers down their spine.
There was a large yard in front of my grandma’s house, next to it was a big pond. In front of the yard, there was a vegetable garden on one side and a large orchard on the other side. Sunlight hardly entered the orchard during the daytime. There were many ghost stories about that orchard. There were vast paddy fields around this house, as far as the eyes could see. Seeing those tow-coloured paddy fields in the foggy winter morning, it seemed as if someone had sprinkled gold all across the field.
Winter mornings in the village felt anything but repetitive. Some days we woke up to the clamour of villagers of harvesting paddy, bundling them up and laying them over the courtyard. Maybe the next day we got up to the sound of threshing. Aunts used to clean the threshed paddy by the pond. Some morning afterward the crops were boiled to separate the grains. Sometimes some ‘Dhan-vapa pitha’ (sort of rice cake) wrapped in banana leaves could be found as a hidden treasure with the spread boiled paddy. How delicious it was to eat that pitha drenched in date juice!
This is how the holidays came to an end. Those beautiful, mesmerizing villages are no more. Neither the bright starry sky nor the full moon can be enjoyed in the light of electricity. Along with this modern technological civilization, that natural abundance also needs to come back. I hope that your generation will take on that responsibility.
Love,
Your Grandmother.
Author: Nabilah Nargis
Occupation: Student
Location: Saichabunia village of Barabighai union in Patuakhali district
Age: 23
Ethnicity: Bengali
Building Materials: Mud, wood, bamboo, thatch, tree stump
Construction period: About 150 years ago
হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।
আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।
বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/
ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com
Disclaimer:
CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website