মূল চিঠি:
প্রিয় সখী রাজওয়া,
আমার ছোট্ট সোনা নানুভাই! সবে বসতে শিখেছো তুমি। হামাগুড়ি দিয়ে বিছানায় চারিপাশ ঘুরতে চাও। একদিন হাঁটতেও শিখবে! ছুটে বেড়াবে এদিকওদিক! তবে এই শহুরে পরিবেশে ছোটাছুটি করতে একটু কঠিনই হবে! ফ্লাটবাড়ির গন্ডি নগরজীবন কে সীমিত করে তুলেছে।
আমাদের সময় এমন ছিলোনা! ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে! আমাদের বাড়ি যশোর জেলার বাগআঁচড়া গ্রামে। বেত্রাবতী নদীর ধারে সবুজ বনানীতে ছাওয়া সেই বাড়ি। বাড়িতে ঢোকার পথে দুপাশে লিলি ফুলের গাছের সারি লাগিয়েছিলাম আমি। আম, জাম আর পেয়ারা গাছে চড়ে সারাদিন খুশিতে দোল খেতাম। মা সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে আমাকে খুঁজে পেতেন না! তখন গাছ থেকে আমি বলতাম, মা আমি পেয়ারা গাছে! আমার দস্যিপনায় মা তটস্থ হয়ে থাকতেন।
নারিকেল আর সুপারিগাছের সারিতে ঘেরা ছিলো আমাদের বাড়িটা। পূর্বে লেবু বাগান ছিলো। বড় উঠানের দক্ষিন পুবে ধানের গোলা, পশ্চিমে গোয়াল ঘর, টালিতে ছাওয়া। দক্ষিণে টালিতে ছাওয়া মাটির বৈঠকখানা, ভেতরে চেয়ার, টেবিল আর একটা খাট পাতা, সামনে-পিছনে বেশ বড় বারান্দা।
পূবদিকে পাঁচফুট মাটির ভিতের উপর অনেক বড় আকারে মাটির চৌচালা ঘর, উপরে ছনের ছাউনি। এই ঘরে উঠার জন্য মাটির পাচটি সিড়ি ছিলো। উত্তর ও পশ্চিমে প্রশস্থ বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হতো । বারান্দায় একপাশে নামাজ পড়ার জন্য একটি চৌকি আর অন্যপাশে একটা বড় খাট পাতা। মাঝে মাঝে সেই খাটে বসে ভাইবোন লুডু খেলতাম। ঘরের ভিতরে দক্ষিণে বড় পালংক, উত্তরে দরজার পাশে একটা খাট, পুবে একটা শো’কেস আর একটা কাঠের সিন্দুক ছিলো। বড় ঘরের উত্তরে আব্বা-মা এর ঘর ছিল। এঘরের পশ্চিমে বারান্দা ছিল।
সব ঘরই মাটির ছিল। তবে বাকি ঘরগুলোতে দুইটি সিড়ি বেয়ে উঠতে হতো। ঘর গুলোর মেঝে এটেল মাটি পানিতে গুলিয়ে পাটের ফেসো দিয়ে লেপতে হতো । সপ্তাহে একবার কাজের মেয়েরা এ কাজ করত। উঠানে গোবর-পানি মিশিয়ে লেপতে হতো । ছনের ছাওয়া আরও দুটো মাটির ঘর ছিলো উত্তর দিকে। এ ঘরগুলোতে খাট পাতা থাকত, মূলত শস্য জমা রাখা হতো । তার পাশেই বড় রান্নাঘর, একপাশে মাটির চুলা, অন্যপাশে আমরা সবাই মিলে একসাথে খেতে বসতাম।
উঠানে ধান, মরিচ-ডাল সহ নানান শস্য রোদে শুকানো হতো । রান্নাঘরের সামনে ছিল মস্ত বড় একজোড়া মাটির চুলা। চুলায় বাগানের শুকনো কাঠ ব্যবহার করা হতো । চুলায় কখনো ধান সিদ্ধ করা হতো। কখনো খেজুরের রস জ্বাল দেয়া হতো। চাঁদনী রাতে উঠানে পাটি বিছিয়ে ভাইবোন মিলে গল্পের আসর হতো। আম্মা -আব্বাও এসে যোগ দিতেন। কত মজার মজার গল্প শোনাতেন মা। মাঝে মাঝে আমরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় উঠানে হাডুডু, কানামাছিও খেলতাম!
বৈঠকখানার পাশে টিউবওয়েল আর গোসলখানা ছিলো মেহমানদের ব্যবহার করার জন্য। ভিতর বাড়ির উত্তরে নিজেরা ব্যবহার করতাম অন্য একটা গোসলখানা। বাড়ির পূবদিকে একটা পুকুরও ছিলো।
সজনেগাছ, বেলগাছ, কুলগাছ, জামরুল, গোলাপজাম, বাতাবিলেবু আর খেজুরগাছ ছিলো উঠানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে। পুকুরের মাছ, উত্তরে রান্নাঘরের পাশে তৈরি করা জাংলার সবজি আর ক্ষেতের শস্য ছিলো আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য । পুকুরে মাঝে মাঝে বঁড়শিতে চেলা, মেনি ও পুটিমাছ ধরতাম! কি যে আনন্দ হতো আমার! মাও খুশি হতেন তা দেখে!
বেত্রাবতী নদীতে জোয়ার ভাটা হতো। আব্বা নদীর পাড় ধরে উঁচু করে পায়ে হাঁটার পথ করে দিয়েছিলেন। সকাল সন্ধ্যায় আমরা নদীর ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতাম। একবার নদীতে জোয়ারের সময় পাড়ে বসে দেখছিলাম পাট জাগ দেয়া পানিতে মাছগুলো খাবি খাচ্ছে! আমি পানিতে নেমে ফ্রকের কোছরে করে বড় একটা রুইমাছ ধরলাম! বাড়িতে আনার পর মা দেখে তো অবাক! ভাইবোনরাও খুব খুশি। সেদিন সেই মাছ খেয়ে কী যে আনন্দ হয়েছিল!
নদীর পাড়ে আমাদের ক্ষেতের পাশেই ছিলো বিশাল বাঁশঝাড়। এই বাঁশঝাড়ে অনেক শিয়াল, খেক শিয়াল, সজারু ছিলো। রাতের বেলা সজারুর হাটার শব্দে মনে হোত সজারুর কাটা দিয়ে যেন ঝুনঝুনি বাজাচ্ছে। আব্বা বলতেন, চিতাবাঘও নাকি আসতো আমাদের বাগানে। সুন্দরবন বেশি দূরে নয় বলে সেখান থেকে বন্যপ্রাণীরা মাঝে মাঝে গ্রামের লোকালয়ে এসে হানা দিতো! অনেক সাপও ছিলো আমাদের বাড়ির আশেপাশে। একদিন ভোরবেলা পুকুরে অযু করতে যাবার সময় একটা সাপের উপর পা দিয়ে ফেলেছিলাম! ভাগ্যিস দূর্ঘটনা ঘটেনি।
খরগোশ, কাঠবিড়ালি ও নানান পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকতো আমাদের বাড়িটা। তখন সন্ধ্যা হলেই কেরোসিনের বাতি জ্বালাতেন মা। ভাইবোন বৈঠকখানার টেবিলে বসে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করতাম!
রাতে একা একা বাড়ির আসেপাশে ঘোরা বারণ ছিলো। বাঁশঝাড়ে নাকি ভুতপ্রেত আসতো! আমার একবার সখ হলো আমাবস্যা রাতে ভুত দেখবো! অবাক হচ্ছো! আমি ওসব বিশ্বাস করতাম না। সে রাতে, সাহস করে বাঁশঝাড়ের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোথায় কি…ভুতের নামগন্ধও পেলাম না।
এদিকে মা ঘুমের ঘোরে দেখেন বিছানায় আমি নেই! উঠে হ্যারিকেন নিয়ে আমাকে খুঁজতে বেরুলেন। আমার কানে মা’র ডাক ভেসে এলো…. ফ-রি-দা…..
বাঁশঝাড় থেকেই উত্তর দিয়েছি…. আমি এখানে মা! ভুত দেখতে এসেছি! কাছে এসে আমাকে দেখে মা হাপ ছেড়ে বাঁচলেন!
আমি যে দস্যিপনাই করতাম এমন নয়। পড়াশোনায়ও ভালো ছিলাম। ভাইবোনদের মাঝে মধ্যমণি ছিলাম। বাজার থেকে সন্দেশ, মিষ্টি কিম্বা ভাজাপোড়া কিনে আনলে আব্বা আমাকে বেশি করে দিতেন। আমি অবশ্য পেটুক ছিলাম না! বেশি অংশটা সবাই মিলেমিশে খেতাম। রাতে ঘনসরের দুধভাত খাওয়ার সময় বেশিটুকু ভাইবোনের কাছে বিক্রি করতাম। কে কিনবে দুধভাত? ভাই বলতো আমি নেবো! এভাবে দুধ ভাত বিক্রি করে এক আনা, দু আনা করে জমা করতাম।
প্রতিদিন ভাইবোনদের হাতে আব্বা পয়সা দিতেন। আমরা মাটির ব্যাংকে তা জমাতাম। ধীরে ধীরে অনেক পয়সা জমা হতো। কখনো প্রয়োজন হলে আব্বা জিজ্ঞেস করতেন কে দেবে ব্যাংকের জমানো টাকা! হুলস্থুল পড়ে যেতো আমাদের মাঝে কে আগে দেবে। পরে আবার মাটির ব্যাংক কিনে এনে একে একে সবাইকে দিতেন। নানা রঙের ব্যাংক পেয়ে আমাদের মন নেচে উঠতো।
আমাদের স্কুল ছিলো বাড়ির কাছেই। ছেলেমেয়ে মিলে একসাথে পড়তাম আমরা। ঝর্ণা ছিলো সহপাঠী, রেবেকা একক্লাস নিচে, সখিনা আর মাশকুরা পড়তো একক্লাস উপরে। মাশকুরা অনেক দূর থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতো। দিলীপ, মোতালেব, শরীফ, বাবলু, সিরাজ সবাই দলবেঁধে আমাদের বাড়িতে এসে গাছ থেকে পেয়ারা, আম, কুল, জামরুল পেড়ে খেতো এবং খেলাধুলা করতো। মাঝে মাঝেই ওদের সাথে আমাদের বাগানে চড়ুইভাতি করতাম। কতনা আনন্দ করেছি বন্ধুদের সাথে।
সেই সবুজ প্রকৃতির স্মৃতি আর আমাদের বাড়ির শান্তসুন্দর পরিবেশের কথা এখনো মনের মধ্যে দাগ কেটে আছে। চোখ বন্ধ করলেই চাক্ষুষ যেন অনুভব করতে পারি। তোমরাও বড় হয়ে যেন সে রকম সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারো।
ভালো থেকো নিরন্তর!
ইতি,
তোমার সখী!
নামঃ ফরিদা বেগম
পেশাঃ গৃহিনী
বয়সঃ ৬৫ বছর
এলাকাঃ গ্রাম-বাগআঁচড়া, উপজেলা- শার্শা, জেলা- যশোহর
পূর্বপুরুষঃ মুন্সী ফজলুর রহমান, কৃষিজীবি ও ব্যবসায়ী, (পিতা), মুন্সী আব্দুল জব্বার, মাঝি ও ব্যবসায়ী (পিতামহ)
নির্মানকালঃ সম্ভাব্যকাল প্রায় দেড়শত বছর আগে নির্মিত
Courtesy: Ar. Swagota Rownak
English version | Translated by Nowshin Matin.
Dearest Rajwa,
My little grandchild! You just learned to sit! Now you want to crawl around the bed. One day you will learn to walk! Your feet will be all over the place! However, running in this urban environment may be a little challenging. City apartments have restricted urban lifestyles to a large extent.
Our time was not like that! I miss my childhood very much! Our home is in Bagachra village of Jessore district. Our home is shaded by a green forest along the Betravati river. On the way to the house, I planted rows of lilies on both sides. I used to climb mango, blackberry and guava trees and happily swing all day long. My mother could not find me all over the house! Then I would say from the tree, “Ma, I am on a guava tree!” My mischief would cause my mother great worries.
Our house was surrounded by rows of coconut and betel trees. There used to be a lemon orchard. To the south-east of the large yard is a paddy field, and to the west is a barn with clay tile roofs. On the south side, a guest room made of mud and tiles is located, with chairs, a table, a bed sheet inside, and a large front and back porch.
To the east is a large earthen house raised on a five-foot earthen foundation, with a chauchala thatched roof. There are five earthen steps that lead to this house. The house had to be entered through a wide verandah to the north and west. On one side of the verandah there is a stool for prayers; on the other, there is a big bed. Sometimes my siblings and I would sit on that bed and play snake and ladder. Inside the house was a large couch on the south side, a bed by the door on the north side, a showcase and a wooden chest on the east side. To the north of the big house was my parents’ house. There was a verandah to the west of the house.
All the houses were built with mud. But the rest of the houses were just two steps up. Mud plinths and floors needed to be coated with clay using jute cloths. The household helpers used to do this once a week. The courtyard had to be coated with cow dung and water. There were two more thatched mud houses on the north side. These houses had beds, but they were mostly used to store grain. Next to it was a big kitchen, with an earthen stove on one side and we all ate together on the other side.
In the courtyard, various grains including paddy, chilli and pulses would be dried in the sun. In front of the kitchen was a huge earthen stove. The dry wood from the gardens would have been used in the stove. Rice grains would sometimes be boiled in it. Sometimes date juice would be burnt. On a moonlit night, all siblings would spread a mat for a story-telling session. Mother and father would also join. It was always fun to listen to our mother’s stories. Sometimes we used to play Hadudu and Kanamachhi on the court under full moonlight!
Next to the living room was a tubewell and bathroom for guests to use. Inside the house, there was another bathroom for family use. There was also a pond on the east side of the house.
Sajane tree, Bel tree, Kul tree, Jamrul, Golapjam, Batabi Lebu and Khejur tree were on the north and south sides of the court. Fish from the pond, vegetables grown in the wild beside the kitchen to the north, and agricultural produce were our daily food. Sometimes we used to catch Cheli, Meni and Puti fish in the pond with a fishing rod! What a joy that would be! Seeing it would also make my mother happy!
The tides used to flow in the Betravati river. My father made a path to walk along the river bank. We would wander in the breeze along the river in the mornings and evenings. Once I was sitting on the bank of the river at high tide and saw fish gasping at the water’s surface! I went down into the water, caught a big Ruhi fish, and tied it to my waist! Mother was so surprised when she saw it at home! There was a lot of happiness among my siblings. What a joy it was to eat that fish that day!
There was a huge bamboo groove next to our field near the riverbank. This bamboo groove was home to many porcupines and foxes. Porcupines walking at night made a rattling sound with their quills. Father used to say that leopards would also come to our garden. Since the Sundarban was not far away from there, the wild animals would sometimes come and attack the village! There were many snakes around our house. One morning when I was going to perform ablution in the pond, I stepped on a snake! Thankfully, there wasn’t an accident.
Our house used to buzz with birds, rabbits and squirrels chirping. Mother used to light the kerosene lamp as soon as evening dawned. My siblings and I used to sit at the living room table and study in the light of the hurricane lamp! It was forbidden to go around the house alone at night. It was believed that ghosts come to the bamboo grove! I once wished to see ghosts by myself at night! Surprised? I never believe in ghosts. That night, I dared to walk around the groove. Where? I didn’t even smell the ghost! When mother woke up and didn’t see me in bed, she went out to look for me with the hurricane lamp. Mother called, “Fa – ri – da!” …..I replied from the bamboo bush ….”I’m here Mother! I came to see ghosts!” She was relieved to see me!
It is not like I would always be mischievous. I was also studious. I have always been the most loved of my siblings. Father used to give me more whenever snacks were bought from the village market. Obviously, I’ve never been greedy! Most would always be shared between us. I used to sell the bigger portions to my siblings while having thick milk and rice in the evening. When I asked, “Who buys milk-rice?”, my brother would say, “Me!” In this way, I sold milk-rice, collected a few pennies and slowly saved them.
Father used to give us some money every day. We used to deposit it in the penny bank. Gradually, a lot of money was saved. If ever there was a need, my father would ask if anyone wished to lend some money! It would be chaos in deciding who among us would give it first. Later he used to buy new banks for all of us. We would be delighted to get different coloured penny banks.
Our school was close to our house. Boys and girls used to study together. Jharna was one of my classmates, Rebecca was one class below, Sakhina and Mashkura were one class above. Mashkura used to come to school by bicycle from far away. Dilip, Motaleb, Sharif, Bablu, and Siraj all came to our house in groups to eat guava, mango, kul, and jamrul from the trees and play games. Often we would have a picnic in our garden together. What a joy it was to be with friends.
I still cherish the memories of that green nature and the peaceful atmosphere of our home. I can feel it closing my eyes. I hope you can build such a green world as you grow up.
Hope you are always well!
Goodbye,
Your friend
Disclaimer:
CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website