বসতবাড়ি | চিঠি ৪ | পুবে হাঁস,পশ্চিমে বাঁশ, উত্তরে কলা আর দক্ষিণে খোলা

15 December, 2020 Total View: 57

Ancestral home of Rabeya Khatun | Visualization and inking by Saad Ben Mostafa & colouring by Kazi Fariha Tasnim © CONTEXT

মূল চিঠি:

প্রিয় বাবু ভাইয়া,

আশা করি ভাল আছ। কাল রাতে স্বপ্নে হঠাৎ করে আমার গ্রামের বাড়িটার কথা মনে পড়ল; মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানায়। বাড়ির পূর্বদিকে ছিল একটা চৌকোনা পুস্করনি। আমার বাবা বলতেন, পৃথিবী চারকোনা, তাই পুকুরও চারকোনা হওয়া উচিত। পুকুরের টলমলে গলা ছুঁই ছুঁই পানিতে হাঁসেরা ঘুরে বেড়াতো। আর পাড়ে ছিল শান বাঁধানো ঘাট। আমার মা সবসময় ছড়া কাটতেন,”পুবে হাঁস ,পশ্চিমে বাঁশ, উত্তরে কলা আর দক্ষিণে খোলা।“ মা বাবা যে ঘরটায় থাকতেন তা বেশ উঁচু, পুকুর কাটা মাটি দিয়ে এই ভিটে তোলা হয়েছিল যেন বন্যায় না ভিজে। ভেজা মাটি অসুখ বিসুখের কারণ।

বাড়ির মাঝখানে ছিল মস্ত এক উঠান। সেই উঠান আমাদের কল্পনার রাজ্য আর বড়দের কাছে তা গৃহস্থালি কাজের ক্ষেত্র। বড় বিচিত্র এই উঠান। যখন  আমার বোনের জন্ম হয়, উঠানে সে কি ভিড়, যেন সমস্ত আনন্দ আজ উঠানেই। আমার বিয়ের দিন ও একই অবস্থা। কিন্তু যেদিন দাদি মারা গেলেন, একই উঠান কেমন বিষাদে ভরে গেলো। দিনে রাতে, শীতে- গ্রীষ্মে নানারকম রঙ বদলায় এই উঠান।

শোনো, আমাদের বাড়ি ঘিরে ছিল নানাজাতের গাছ। নিম, নিশিন্দা এগুলো হল ভাল জাতের গাছ। এগুলো বাড়ির যত কাছে থাকবে তত ভাল। আবার বাঁশের ঝাড় ও উপকারী কিন্তু তা পশ্চিম দিকে একটু দূরে রোপণ করতে হয়। সারাদিনের রোদ এই ঝাড় ভেদ করে আসতে পারতো না তাই এর ছায়া আমাদের ঘরগুলিতে প্রশান্তি এনে দিত। পশ্চিমের রোদ বাঁশের ঝিরি ঝিরি পাতায় খেলা করত আর কেমন জানি মায়াবী এক আলো ছায়ার পরিবেশ তৈরি করত। মা বলতেন, বাড়ির দক্ষিণে খোলা রাখতে হয় আর তালগাছ কখনই বাড়ির কাছে দক্ষিণে রোপণ করে না। কারণ শকুন তালগাছে বাসা বাধে আর মরা খেয়ে বাতাসের সাথে রোগ ব্যাধি ছড়ায়। বেল, তেঁতুল আর বড়ই- এগুলো উত্তরে রোপণ করা যাবে না কারণ ভুতের ভয়তো আছেই, এরা ঘরকে আবদ্ধ করে ফেলে উত্তরের আলো ও বাতাস থেকে। বর্ষাকালে আছে সাপের উপদ্রব, তাই ঘরের কাছে বকুল, চাঁপা থাকা চলবে না।

আমি থাকতাম উঠোনের পশ্চিম দিকের ঘরটায়। ভাই বোনেরা সব একসাথে। এটাকে বলা হত পূবদুয়ারী ঘর। কিন্তু সবচেয়ে ভাল ঘর হচ্ছে মা বাবারটা। উত্তরদিকে এর অবস্থান আর নাম ছিল দক্ষিণদুয়ারী ঘর। আর জানো তো যে উত্তরে সূর্য ওঠে না, তাই মনোরম আলো ছিল সেই ঘরে। শীতকালে জানালা বন্ধ করে দিলেই আর উত্তরের হিম বাতাস আমাদের কাবু করতে পারত না। তাই সবাই জড়ো হতাম এই ঘরেই। পূর্বে আর দক্ষিণে সচরাচর থাকার জন্য ঘর তোলা হত না। দক্ষিণে কাছারিঘর ও বৈঠকখানা ছিল। আর পূর্বদিকে ছিল ফাঁকা, কোনায় রসুইঘর, গোলা ও গোয়ালঘর।

উত্তরে দল বেঁধে আসত বানর। তাদের উদ্ভট খেলা, ল্মফঝম্ফ ছিল আমাদের হাসির খোরাক। কলার বাগানে তারা প্রায়ই হানা দিত। বাঁশঝাড়ে মগডালে  বাসা বাঁধত ঘুঘু জোড়া। মাঝে মাঝে তাদের ডিম চুরি করত দুষ্ট ছেলের দল। উঠানে ছাগল ছানাদের তিড়িং বিড়িং আমাদের আনন্দ দিত। মাঝে মাঝে মুরগির ছানা ছো মেরে নিয়ে যেত কাক-চিল। রাতে ঈশান কোণের তেঁতুলগাছে শুনতে পেতাম হুতুম পেঁচার ডাক, সে কি ভয়ঙ্কর তার কণ্ঠ।  শেয়ালের হুক্কাহুয়া শুনতাম, কিন্তু মাঝে মাঝে মুরগি চুরি করে নিয়ে যেত ওরা। আমার প্রিয় লাল ঝুঁটির সাদা মোরগটাকে যেদিন নিয়ে গেল, সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। বসন্তে ডালে ডালে শুনতে পেতাম কোকিল- বউ কথা কও পাখির কুহু-কুজন। 

আমার বাবা সেই ব্রিটিশ আমলে স্টিমারে চেপে কলকাতায় যেতেন কয়েক মাসের জন্য। ছাপাখানা আর বই বাঁধাইয়ের কাজ- খুবই লাভজনক আয় রোজগার। কিছু টাকা জমলে পরে বাবা ঢাকায় জমি কিনেন। শুনলে আশ্চর্য হবে, নৌকায় বাড়িঘরের সবকিছু খুলে নিয়ে আমরা ঢাকায় চলে আসি। ঢাকার ছোট জমিতে স্থানাভাবের কারনে কোন উঠান রাখা যায় নি। কিন্তু বাইরে একটা দোকান দেওয়া হয় রাস্তার সাথে।

তুমি তো ভাই অনেক বাসাবাড়ি বানাও। পারবে নাকি আমাকে আবার গ্রামের সেই উঠান, বাগান ঘেরা একটা বাড়ি বানিয়ে দিতে ?

ভাল থাক ভাইয়া,

তোমার আদরের রাবু (নানু)


রাবেয়া খাতুন (রাবু) স্মরণে যিনি গত ১৩ ই মার্চ ২০২০ সালে তাঁর ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন। তিনি ছিলেন স্থপতি সৈয়দ আহমেদের মাতামহী। তার বসতি ছিল মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার লেচড়াগঞ্জ গ্রামে। মাত্র ৯ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল! শক্তিশালী পদ্মার ভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে বিয়ের পর স্বামীর সাথে পাড়ি জমান নারায়ণগঞ্জ শহরতলীতে। তাঁর জীবনের বাকি সময়গুলিতে, তিনি কখনই ভিটা-বাড়িতে ফেরার সুযোগ পাননি।

Visualization by Md. Raihanul Hai © CONTEXT
Based on the original drawing provided by the sender. Redrawn by: Saad Ben Mostafa © CONTEXT
Visualization by Saad Ben Mostafa © CONTEXT

English version ( Translated by Noshin Tuba)

Dear Babu Bhaiya,

Hope you are well. Last night in a dream I suddenly remembered my village house; Harirampur police station in Manikganj district. To the east of the house was a square pond. My father used to say, the earth is square, so the pond should also be square. Ducks used to swim around on the neck-touching water of the pond. And on the bank was a paved stairway (ghat). My mother always used to cut rhymes, “duck in the east, bamboo in the west, banana in the north and open in the south.” The room where my parents lived was quite high, with the soil cut from the pond so that it would not get wet in the flood. Wet soil could cause diseases.

There was a big yard in the middle of the house. That yard was the realm of our imagination and for adults, it was the field of household chores. Very miscellaneous this yard was. When my sister was born, what a crowd was in there as if all the joy was in the yard that day. The same situation was on my wedding day. But the day Grandma died, the same yard got filled with sadness. Day and night, winter and summer – this yard changed colours in different ways. 

Listen, there were varieties of trees and plants around our house. Neem, Nishinda, these are good sorts of trees. The closer they remain to the house, the better. Again bamboo bushes are also useful but they have to be planted a little further west. The sunbeam could not penetrate this bush all day so its shade used to bring tranquillity to our house. The daylight of the west used to play on the bamboo leaves and created somewhat a mesmerising environment of light and shadow. My mother used to say that the house should be kept open on the south side and palm trees should never be planted on the south side of the house. This is because the vultures nest in palm trees and eat the dead, which would spread disease through the wind. Wood apple, tamarinds and plum trees – these can’t be planted in the north because there is a fear of ghosts, these trees block the house from the light and wind of the north. There was an infestation of snakes in the rainy season, so Bokul, Champa etc. trees should not stay close to the house.

I lived in the room on the west side of the yard. Brothers and sisters all together. It was called ‘Poobduari Ghar (east-faced room)’. But the best room of all was our parents’ one. It was located on the north side and was called ‘Dakshinduari Ghar (south-faced room)’. And you know that the sun does not rise in the north, so there remained a beautiful soft light in that room. If we closed the windows in the winter, the cold north wind would not be able to overwhelm us. So everyone used to gather in this room. Rooms were not usually built in the east and south for living purpose. To the south were the ‘kachhari ghar (meeting room)’ and living room. And the east was empty, at a corner, there were the kitchen, granary and the cattle.

Monkeys used to come in troops to the north. Their bizarre plays, dances-prances were the laughing stock for us. They often attacked the banana orchards. A pair of doves nested at the top of the bamboo bush. Sometimes groups of brats used to steal their eggs. Gamboling of the baby goats in the yard amused us. Crows and hawks often used to snatch away the chicks. Sometimes, at night, we could hear the hoot of the owl from the tamarind tree at the north-east corner, what a terrible voice it had! Used to hear foxes howling, but sometimes they used to steal chickens. The day they took away my favourite red-crested white rooster, I cried a lot. In the spring, we could hear the song of the cuckoo, chirping of Bou-kotha-kow bird here and there in the branches.

My father used to go to Kolkata by steamer for a few months during the British era. For printing press and bookbinding business – a very lucrative way of income. After collecting some money, father bought land in Dhaka. You will be surprised to hear that we unscrewed all the parts of the house and brought them with us by a boat when moved to Dhaka. No yard could be arranged in the small land of Dhaka due to lack of space. But outside along the street, a shop got placed.

You build so many houses, dear, don’t you? Can you make me a village house again with that courtyard in it, surrounded by gardens?  

Stay well, bhaiya.

Your beloved Rabu (Nanu)


In memory of Rabeya Khatun (Rabu) who died on 13th March 2020 at her 75. She was the maternal grandmother of Architect Sayed Ahmed. She lived in a village called Lechraganj, Harirampur thana at Manikganj district. She got married at the age of 9! The mighty Padma took their home at its womb and she had to move out with her husband at Narayanganj. In rest of her life, she never had the chance to return home.

We are thankful to Architect Sayed Ahmed for his correspondence.


হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।

আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।

বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/

ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com


Disclaimer:

CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website.

PEOPLE ALSO VIEW