বসতবাড়ি | চিঠি ২৬ | চৌরী ঘর

1 September, 2023 Total View: 125

Letter by: Md. Main Uddin | Illustration by Taorem Rahul; Color by Samiha Nawshin © CONTEXT

মূল চিঠি:

সুপ্রিয় অনাগত দাদু,

শুভ কামনা রইল। আমি আজ তোমার জন্য আমার ছেলেবেলা, বেড়ে উঠা এবং গ্রামীণ জনপদের কিছু স্মৃতিকথা ব্যক্ত করতে চাই; যাতে তুমি তোমার পূর্ব পুরুষ, তাদের ভিটেমাটি সম্বন্ধে জানতে পার।

জীবনের বড় একটা অংশ ঢাকায় কাটালেও আমি ছিলাম গ্রাম থেকে উঠে আসা এক তরুণ। মানিকগঞ্জের মুলজান গ্রামে এক সচ্ছল কৃষক পরিবারে আমার জন্ম। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ঘেঁষে আমাদের বাড়ি। ফরায়েজী বাড়ি বললেই লোকে চিনেন। আমি জ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই বাড়ির চার ভিটায় চারটি ঘর দেখতে পেয়েছি। উত্তর ভিটায় বড় আকারের একটি টিনের ঘর। সেখানে দাদা দাদী থাকতেন। মজার কথা জানো? আমরা এখনও এই ঘরকে “বড় ঘর” ডাকি। যাহোক, অন্য বড় ঘরটি ছিল পশ্চিম ভিটায়। সে ঘরে বাবা-মা তাঁদের ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকতেন। দু’টি ঘরেরই ভিত / প্লিন্থ ছিল পাকা। ভেতরের পিলারগুলি আগে ছিল বাগানের গাছের। পরে দরকার মত আমরা কনক্রিটের পিলার করে নিয়েছি। এর ওপর টিন দিয়ে করা বাইরের, ভেতরের দেয়াল। টিনের চৌচালা ছাদ ছিল দু’টোরই। এমন ঘরকে বলা হত ‘চৌরী ঘর’!

দক্ষিণ ভিটায় লম্বা আকৃতির একটি টিনের ঘর। সেটি ব্যবহৃত হত গোয়াল ঘর হিসেবে। অবশ্য, এ ঘরেরই পূর্ব পাশে পার্টিশন দিয়ে আলাদা একটি ছোট ঘর ছিল যাকে বলা হতো ‘বাংলা ঘর’। সেখানে তামাক, হুক্কা, বসার ব্যবস্থা, শোবার চৌকি সবই ছিল। রাতে রাখালেরা এ ঘরেই থাকতো। দক্ষিণে খোলা জায়গায় ছিল গরুর খাবারের জন্য গরুর গোরা। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ছিল ঘোড়ার আস্তাবল। এই ঘোড়ায় চড়ে আমার দাদাভাই হাট-বাজারে এবং বিচার-সালিশে যেতেন।

পূর্বের ভিটায় ছিল বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো বিশাল এক ঘর, যার ছাদ ছিল ছনের। এর একটি অংশ ঢেঁকির ঘর এবং বাকিটা রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। শুকনো মৌসুমে রান্না ঘরের পাশে খোলা জায়গায় রান্নাবান্না করা হতো। অন্যদিকে বৃষ্টি বাদলের দিনে রান্না ঘরেই রান্নাবান্না করা হতো। এঘরেই একপাশে একটি মাচা ছিল যেখানে কাঠের লাকরি, গরুর গোবর শুকিয়ে তৈরী করা ঘুটে ইত্যাদি জ্বালানি হিসেবে মজুদ থাকতো। বলতে দ্বিধা নেই যে এই ঘরেই আমরা ভাই বোন সকলেই গ্রামের একজন দক্ষ ধাত্রী (দাই) এর হাতে জন্মলাভ করেছি। শুধু তাই নয়, গ্রামের অনেক নারীই সন্তান জন্মদানের জন্য ফরায়েজী বাড়ির এই ঘরে আশ্রয় নিতেন। এটাকে গ্রামীণ ভাষায় ‘ছটি ঘর’ বলা হতো। এই ধাত্রী (দাই) অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তাঁর হাতে কোন নবজাতক মারা গিয়েছে এরকম কিছু শুনিনি। তিনি এই ঘর ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। আমার পরিবারও এই কাজে এই ঘর ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেন নি কখনও।

বাড়ির দক্ষিণ পশ্চিম কোনে ছিল বিশাল খড়ের পালা। পূর্ব পাশে ছিল কয়েকটি আম গাছ এবং দক্ষিণ পাশে ছিল কয়েকটি খেজুর গাছ। গ্রীষ্মকালে আমরা গাছের কাঁচাপাকা আম খেতাম এবং শীতকালে খেজুরের রস এবং রস দিয়ে তৈরি খেজুরের গুড় খেতাম। এই খেজুরের গুড় ছিল আমার খুব প্রিয় খাবার। দিনে এক পাটালি গুড় না খেলে আমার তৃপ্তি হতো না।

বাড়ির সামনে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে একটি খাল ছিল। কালিগঙ্গা নদীর সাথে এই খালের সংযোগ ছিল। বর্ষাকালে এই খালে ভীষণ স্রোত থাকতো। এই খালে আমরা শৈশবকালে সাঁতার কাটতাম, কলা গাছের ভেলায় চড়ে মনের আনন্দে ভেসে বেড়াতাম। খালে জেলেদের পাতা ‘ভেসাল’ জালে ধরা তাজা নলা, ভেটকা, বোয়াল, টাটকিনি, রায়েক, বেলে, চিংড়ি ইত্যাদি মাছ কিনে আনতাম।

আমার বাড়ির এক মাইল দূরে ডাউটিয়া হাট। সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবার হাট (বাজার) বসতো। শুকনো মৌসুমে গ্রামের লোকজন পায়ে হেঁটে হাটে যেতো। বর্ষাকালে সকলে মিলে নৌকায় যেতো। গ্রামের কয়েকটি পাড়ার মধ্যে আমাদের একটি বড় নৌকা ছিল। গ্রামের লোকজন এ নৌকায় হাটে যাওয়া করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো।

শীতকালে পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যেতো। পৌষ মাঘ মাসের সকালে রৌদ্রে বসে খেজুর গুড় দিয়ে মুড়ি খেতাম। গ্রামের লোকে মুড়িকে বলতেন ‘উড়ুম’। এই স্মৃতিগুলি লিখতে গিয়ে উপমহাদেশের  কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী মান্না দে’র একটি গানের কথা মনে পড়ে গেলঃ

“পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন

ফিরে আর আসবে কি কখনো!”

এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌছবে তখন হয়তো ইহজগতে নাও থাকতে পারি। তবে, আমি না থাকলেও এর মাধ্যমে তুমি সেকালের জীবন ব্যবস্থা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পাবে আশা করছি।

 

তোমার অনাগত জীবন সুন্দর, সাবলীল ও সুখময় হোক- এই কামনা করি।

 

তোমারই দাদুভাই

মোঃ মঈন উদ্দিন

১৫ এপ্রিল, ২০২১

(সৌজন্যে: নাজিয়া তারান্নুম)

 

Plan Render and Annotation by Md Akibur Rahman Sikder © CONTEXT

Illustration by Taorem Rahul

Visualization by Taorem Rahul

 

Visualization by Taorem Rahul

English version | Translated by Labiba Nazeen

Dear unborn grandchild,

Sending you my best wishes. Today, I would like to share some memories from my childhood, youth and the rural life with you so that you may learn more about your ancestors and their homeland.

Though I’ve been living in Dhaka most of my life, I was a young man from the village. I was born in an affluent farmer’s family in Muljan village of Manikganj. Our house was located along the Dhaka-Aricha highway. The house was known to people as the ‘Forayeji Bari’. From the time I can remember, I saw four houses in the four sides of our home. A large house made of CI sheet was in the North, where my grandparents lived. Interestingly, we still call that house “the big house”. The other large house was in the west, where my parents lived with their children. The plinths of both the houses were brick made. The supporting columns were formerly from garden woods, which, later, we made from concrete as needed. The outer and inner walls made of CI sheet. The chouchala (house with four roofs) roof also made of CI Sheet was two-tiered. These types of houses were called ‘Chowree Ghar’ !

There was an elongated house in the South. It was used as cattle shed. However, there was a small room separated by a partition on the east side of this room which was called ‘Bangla Ghar’. There were areas where people may sit and smoke hookah or take rest. At night, the shepherds stayed in this house. Cow sheds were in the open area to the south where cows were fed. In the south-east corner were the horse stables. My grandfather used to ride to the bazaar and the court on his horse.

In the former house there was a large house made of bamboo fence, which had a thatched roof. A part of it was used as a shed and the rest as a kitchen. During the dry season, cooking was done in the open space next to the kitchen. On the other hand, on rainy days, cooking was done inside the kitchen. There was a loft on one side of the house where wood sticks, dried cow dung, etc. were stored as fuel. In this house, all of us siblings were born by a skilled midwife, ‘Dai’ of the village. Nonetheless, many women in the village took shelter in this house of ‘Forayeji Bari’ for giving birth. It was called ‘chothi ghar’ in local language. The midwife was very skilled, and no infant deaths were ever heard, in her hands. She was comfortable using that room and my family also never hesitated to leave this house for this purpose.

At the southwest corner of the house was a huge hayloft. There were some mango trees on the east side and some palm trees on the south side. In summer we ate mangoes fresh from the trees and in winter we ate palm juice and date jaggery. Date jaggery was my favourite and I would not be satisfied without eating one patali jaggery every day.

There was a canal in front of the house i.e. on the south side. This canal was connected to the river Kaliganga. During monsoon, this canal had strong current. We used to swim in this canal as children, and joyfully floated on the raft made from banana leaves. I used to buy fresh fish such as nala, betka, tatkini, rayek, bele (local fish), catfish, prawn etc. caught in the nets of the fishermen in the canal.

A periodic market called Doutiya Haat was located one mile from my home and was held on Mondays and Fridays. During the dry season, the people of the village went to the market on foot and during rainy season, they used boats. We had the largest boat within a few blocks of our village; and the people of the village used to feel comfortable using our boat to go to the market.

In winter, there was an exciting custom of eating Pithapuli (traditional steamed/ fried rice cakes or dumplings filled with local sweet/ savoury items). In the morning of Paush, Magh (winter months of the Bengali Calendar), I used to sit in the sun and eat puffed rice with date molasses. Village people used to call puffed rice ‘Udum’. While reminiscing, I am reminded of a song by the legendary music artist of the subcontinent, Manna Dey:

“পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন

(“It is the day when the sun shines near Poush)

ফিরে আর আসবে কি কখনো!”

(Will you ever come back!”)

 

I may not be in this world when you receive this letter. However, I’m hoping this gives you a good impression of how life was back then.

I wish you a nice, content, and happy future.

 

Your grandfather

Md. Main Uddin

April 15, 2021

(Courtesy: Nazia Tarannum)


হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।

আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।

বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/

ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com


Disclaimer:

CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website

PEOPLE ALSO VIEW