মূল চিঠি:
আদরের নিমো,
আজ তোকে একটা গল্প বলব, আমাদের পুরোনো বাসার গল্প। আমরা যে বাসাটাতে থাকতাম সেটা ছিল ভাড়াবাড়ী। এলাকায় জবা খাঁ’র বাড়ি নামেই পরিচিত ছিল। আব্বু, অর্থাৎ তোর নানা ভাই ব্যাচেলর হিসেবে ওই বাসায় ভাড়া থাকতো। তো, বাড়িওয়ালা (আমরা দাদু বলতাম) একদিন ভাড়াটিয়াদের নাকি এসে বলল, সে আর ব্যাচেলর ভাড়া দেবে না। যদি থাকতে হয় তবে নাকি বউ নিয়েই থাকতে হবে। কি বিপদ, বলতো?! আর এর পরপরই একদম তড়িঘড়ি করেই আব্বু আর আম্মার বিয়ে হয়ে গেল। কারও বিয়ে করার পেছনের মূল কারণ শুধুমাত্র ভাড়া বাসা, ভাবতে পারিস? আর ওই বিয়েতে আমাদের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে বরযাত্রীতে গিয়েছিল এই বাসারই বাড়িওয়ালাসহ অন্যান্য ভাড়াটিয়ারা। যাই হোক, তো এরপর এই বাসাতেই শুরু হল আমার আম্মার নতুন সংসার।
আমাদের এই বাসাটা তৈরি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরপরই, সোনাডাঙ্গাতে তখন ওই একটাই চারতলা বিল্ডিং। শুনেছি প্রথমে এটা হোটেল হিসেবে বানানো হয়েছিল, পরে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। স্থাপনাটা অনেকটা এরকম- মাঝে একটা বড় উঠান, তার চারপাশ দিয়ে করিডোর, আর সেই করিডোর ঘিরে রুম। উত্তর আর দক্ষিণ দিকে দুটি সিঁড়িঘর। বাড়ীর উত্তর অংশ তিন তলা আর দক্ষিণ অংশ চার তলা পর্যন্ত। বাড়ীর পেছনে মস্ত বড় এক পুকুর। মাঝের উঠানটাও আবার একটা যোগ চিহ্নের মতো হাঁটা পথ দিয়ে চার ভাগে ভাগ করা। ওই পথটাই সিঁড়িঘর সহ বাড়িতে ঢোকার প্রবেশ পথ আর বাড়ির পেছনের পুকুরে যাওয়ার পথটাকে যুক্ত করেছে। পুকুরের পাড় ঘেঁষে সারি বেঁধে নারকেল গাছ। এই বাসার সব মহিলা আর বাচ্চারা পুকুর ব্যবহার করতে পারত।
এতক্ষণ যে বর্ণনা দিলাম আমরা কিন্তু বাড়ির এই অংশে থাকতাম না। ১৯৮০ সালের কিছু আগে বাড়ির পেছনে আরও একটা অংশও বাড়ানো হয়। তুই যেমন ইংরেজি P লিখতে একটা বৃত্ত এঁকে, বৃত্তের এক কোনা ধরে নিচের দিকে টান দিয়ে লেজ আঁকিস, ঠিক ওরকম। আমরা থাকতাম P-এর লেজের অংশে। চার তলার এই অংশ সামনের অংশের থেকে উচ্চতায় প্রায় তিন ফিট উঁচু, যার কারণে ছাদের ঠিক যে জায়গাটাতে এই দুই অংশ মিলেছে সেখানে ছোট্ট করে তিনটা সিঁড়ির ধাপ ছিল। আমরা ওই ধাপ বেয়ে ওঠানামা করে এ ছাঁদ, ও ছাঁদ করতাম। আমি ছিলাম ছাঁদ অন্তপ্রাণ। দুপুরের খাবারের পর, ভাত ঘুম না দিয়ে আমি চলে যেতাম ছাদে। একা একা বসে কখনো খেলতাম, কখনো আঁকতাম, এঁকে এঁকে ছাঁদ ভরে ফেলতাম। সন্ধ্যার পর যখন ইলেক্ট্রিসিটি চলে যেত, তখন আমরা সবাই মাদুর নিয়ে ছাঁদে যেতাম। চাঁদের আলোয় বসে আমরা সমবয়সী বাচ্চারা আব্বুর কাছে ভূতের গল্প নয়তো মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতাম। এই ছাঁদে কত যে স্মৃতি! ছাঁদের সিঁড়িঘরের উপরের পানির ট্যাংকির উপরে উঠার জন্য দেয়ালের গায়ে রডের সিঁড়ি বসানো ছিল। সেই রডের সিঁড়ি নিয়ে এই বাড়ীর প্রতিটা ছেলেমেয়ের সুখস্মৃতি আছে। বড় আপুর কাছে শুনেছি, এই পানির ট্যাংকির উপর উঠে নাকি সবাই সোনাডাঙ্গা আবাসিকের ২য় ফেজের ঘোড়ার দৌড় দেখত। আমাদের এই ছাঁদে একটা গোছলের জায়গা ছিল,বাড়ীর ছোট যারা তাদেরকে সরিষার তেল মাখিয়ে শীতের সকালে এখানে গোছল করানো হতো, সেই সময়গুলো না ভারী মজার! বাড়ীতে কারও বিয়ে?- ছাঁদ, মিলাদ?- ছাঁদ, সবাই মিলে পিকনিক?- ছাঁদ। কি হতো না এখানে? আমাদের বাসায় যেই বেড়াতে আসতো আমি তাকে নিয়ে গিয়ে আমাদের মস্ত বড় ছাঁদটা দেখাতাম। দেখার মত একটা জিনিস ছিল বটে!
আমরা চার তলার যে ইউনিটে থাকতাম, সেটা ছিল মূলত দুই পরিবারের জন্য। ইউনিটের মূল দরজা দিয়ে ঢুকে করিডোর, সেই করিডোরের মাথায় একটা বাথরুম। করিডোরের দুই পাশে দুটো দুটো করে চারটা রুম আর সাথে রান্নাঘর। দুই পরিবারের রান্নাঘর ছিল পাশাপাশি, মাঝে ইটের জালি দেওয়া। আমরা ওই ইটের জালির ভেতর দিয়ে খাবার আদান-প্রদান করতাম। প্রথম দিকে আমরা দুই রুমে থাকলেও, পরে অবশ্য পুরো ইউনিট নিয়ে থাকা শুরু করি। এজন্য ঐ ইটের জালি ভেঙে ফেলা হয় আর আমরা দুইটা রান্নাঘরের সমান বড় একটা রান্নাঘর পেয়ে যাই। আমাদের যারা প্রতিবেশী ছিলেন, শুধু একই ইউনিটের বা পাশের ইউনিটের না, পুরো বিল্ডিংয়ের সবার সাথে সবার অনেক সুসম্পর্ক ছিল। শীতকালে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ টা পরিবারে একইসাথে কুমড়ো বড়ি দেওয়া হতো। মা-চাচীদের দেখতাম,একই সাথে ভাগে কুমড়ো আর ডাল কিনতে। এরপর যেদিন ছাঁদে বড়ি দেওয়া হতো সেদিন যেন এক উৎসবের আয়োজন চলতো। আম্মার কাছে শোনা ১৯৮৮-র বন্যাতে যখন বাসার নিচতলা পানিতে ডুবে গিয়েছিল, তখন এলাকার আরো অনেকের সাথে একতলায় থাকা পরিবার গুলো উপরের তলায় থাকা পরিবারগুলোর সাথে এসে থেকেছিল। আর কি জানিস?এত বছর পরও এই পরিবার গুলোর অনেকের সাথে এখনো যোগাযোগ আছে।
আমাদের বাসার পেছনের এই অংশে ছাঁদের প্যারাপেট আর সিঁড়িঘরে টেরাকোটা জালি বসানো ছিল। তাতে অদ্ভুত আলো-ছায়া খেলা করতো। শীতের দুপুরগুলোতে সিড়িতে বসে আমি অবাক হয়ে এই আলো-ছায়া দেখতাম। এই বাসাতে আমার একার অনেক স্মৃতি। আমি আপন মনে এই বাড়ীর আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি। এই বাড়ীর প্রতিটা দেয়াল, দেয়ালের ভাঁজ আমার চেনা। কিন্তু একদিন এই চির চেনা বাড়ীটাও আমাদের ফেলে আসতে হয়েছে। বাড়িটা তো অনেক পুরনো আর এতো পুরনো বাড়ি থাকার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমরা ২০১৮ সালে বাসাটা ছেড়ে দেই। বাসা বদলের দিন, আমি আর আম্মা কাউকে শেষ বিদায় না জানিয়েই চলে আসি। কি জানি? হয়তো সেদিন আমরা নিজেদের কাছ থেকেই পালাতে চেয়েছিলাম। আম্মার ৩৫ বছরের সংসার আর আমার গোটা শৈশবটাকে ফেলে আসা, এত সহজ ছিল না যে!
ইতি,
মা।
প্রেরক: ইশরাত লায়লা নওরীন
পেশা: স্থপতি
ঠিকানা: সোনাডাঙ্গা, খুলনা।
English Version | Translated by: Labiba Nazeen
Dearest Nemo,
Today I will tell you a story, the story of our old home. The house we lived in was rented. It was known as Jaba Kha’s residence in that area. My father, meaning, your grandfather stayed in that house as a bachelor. One day, the landlord (we used to call him grandfather) let the tenants know that he would not rent to bachelors anymore. If one had to stay, he had to stay with his family. Such a jeopardy, would you say?! Hence, soon after that, my father and mother hastily got married. Can you imagine the main reason behind someone getting married is just a rented house? And in that marriage, the other tenants, including the landlord of this house, went from the bridegroom’s side, along with our other relatives. Anyway, then, my mother’s new life and household in that house began.
Our house was built right after the liberation war, the only four-storied building in Sonadanga. As heard, the house was first built as a hotel, then rented out for permanent stay. The structure was a lot like this – with a central big yard, surrounded by a corridor and rooms placed alongside the corridor. There were two staircases, one on the north and the other on the south. The northern part of the house had three floors and the southern part had four floors, segregated into four parts. A big pond was located at the back of the house. The middle yard was also divided into four parts by a walking trail, just like a plus sign. That path connected the entrance to the house with the staircases and also to the pond at the back of the house. Coconut trees lined the banks of the pond. All the women and children could use the pond.
We did not live in this part of the house, the one that I described. Before 1980, another part was added to the back of the house. It was just like you draw a circle to write the English letter, P, and add a tail by pulling down one corner of the circle. We lived in the tail part of P. This four-storied section was about three feet higher than the front, so, at the exact spot where the two parts met, there were three small steps. We used to climb that step and go from roof to roof. I was the heart of the rooftop. After lunch, instead of taking a nap, I would go there. Sometimes I would sit alone and play, sometimes I would draw, and sometimes I filled the roof with drawings. When the electricity went off in the evening, we would all go to the rooftop with a mat. In the moonlight, we, children of the same age, would hear ghost stories or stories of the liberation war from our father. It held so many memories! In order to climb to the water tank above, rod stairs were mounted on the walls of the stair room. Every child in this house has fond memories of that rod staircase. I heard from my elder sister that everyone would get on top of the water tank to watch the second phase horse race of Sonadanga residential area. We had a bathing place on the rooftop, the younger ones of the house used to be covered in mustard oil during winter mornings, and then bathed- those fun times! If there was a wedding at home? – A religious gathering? – Or picnic? – For everything there was the rooftop. What would not happen here? Whenever guests came over, I would take them and show them our big roof. It was indeed something to see!
The unit we lived in, on the fourth floor, was basically for two families. Upon entering the unit, there was a corridor, which led to a bathroom at the end. There were four rooms, two rooms on either side of the corridor and kitchens. The kitchens of the two families were side by side, with brick jali (intricate ornamental openwork) in between. We used to exchange food through that brick jali. Even though we stayed in two rooms at first, later, we started living in the whole unit. As a result, the brick jail was broken and we got to use a kitchen as big as two kitchens. Those of us who were neighbors, not just from the same unit or the unit next door, but everyone who lived in the building, had good relations with one another. In winter, at least 5 to 6 families made pumpkin pills together. I used to see my mother and aunts buy pumpkins and pulses. And on the day, the pills were made, a festival was organized. As heard from my mother, when ground floors of the houses in the area were submerged in the 1988 flood, the families on the ground floor stayed with families on the upper floors. What else do you know? Even after so many years, many of these families are still in contact.
At the back portion of our house, terracotta jali was placed on the parapet and staircase. Astonishing light and shadow played on it. During the winter afternoons, as I sat on the stairs, this light and shadow amazed me. I, alone, have many memories in this house. I have wandered around the knit and cranny of this house on my own. Every wall, the folds of the walls of the house are familiar to me. However, one day we had to leave this closely acquainted house. The house was very old and it became risky to live in such an old house, hence, we left the house in 2018. On the day of our moving, my mother and I left without saying goodbye to anyone. Who knows? Maybe that day we wanted to run away from ourselves. Leaving my mother’s 35-year-old household and my entire childhood behind was not so easy!
Yours,
Mom
From: Ishrat Laila Nowrin
Profession: Architect
Address: Sonadanga, Khulna
হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।
আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।
বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/
ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com
Disclaimer:
CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website.