মূল চিঠি:
প্রিয় নানাভাই,
আজ তোমাকে বলব আমার নানু বাড়ির গল্প। আমরা থাকতাম বরিশাল শহরে, কিন্তু গ্রীষ্মের বা শীতের বন্ধে স্কুল ছুটি দিলেই আমরা চলে যেতাম আমাদের নানুবাড়ি, ঠাকুরমল্লিক । সকালে নতুন বাজার ঘাট থেকে নৌকো নিলে বিকেলেই পৌঁছে যেতাম। মাঝে মাঝে নানুই নৌকো পাঠিয়ে দিতেন, এক মাল্লাই বাশের ছইঅলা নৌকো। নৌকো পার হত কত কত নদী আর খাল, শুধু আড়িয়াল খাঁ নদী আর খয়রাতির খাল দুটো নাম মনে পরে। খাল ধরে সে নৌকো পৌঁছে দিত একেবারে নানুর বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট পুকুরটায়। পাড়ের মস্ত বড় বেল গাছটার শেকড় বেয়ে পৌঁছে যেতাম একদম উঠানে।
খাল ছিল উত্তর দিকে, আর দক্ষিনে ছিল দুই গ্রাম এর সংযোগকারী রাস্তা। দক্ষিনের রাস্তা আর উত্তরের খাল এর মাঝে নানুর বিশাল বাড়ি । রাস্তা আর খালের ওপারে ফসলের খেত। রাস্তার পরেই কাছারি ঘর, এর বেশ কিছুটা দূরে গাছপালার মাঝে দিয়ে পৌঁছানো যেত বিশাল উঠানটায়। উঠানের উত্তরে নানুর সুন্দর টিন আর কাঠের চৌচালা ঘর আর উল্টোদিকে বড় মামার। উঠানের পুব দিকে ছিল বড় রান্নাঘর। লাকরির চুলোটা ছিল এক্কেবারে পুব এ, যেন ধোঁয়া থাকার জায়গায় না পৌঁছে। ছিল একটা বিশাল ঢেঁকি। বৃষ্টির দিনে নানার বাড়ির থেকে একটা ছাউনি দিয়ে রান্নাঘরে যাওয়া যেত।
এটা হল রবিশস্যর এলাকা। উঠানের পশ্চিমেই ছিল চৌকো এক বিশাল গোলাঘর। গোলা ভরা থাকত ফসলে। গোলার পাশে কবুতরের ঘর, আর পিছনে গোয়াল ঘর, একটু গন্ধ থাকত কিনা, তাই বাড়ি থেকে দূরে। গোয়াল এ দুই জোড়া হালের গরু আর এক জোড়া দুধের গাই থাকতো সবসময়। আর বাছুর। দুই জোড়া হালের গরু কেন বলতো? একজোড়া হাল চাষ দিলে আরেকজোড়া বিশ্রাম নিতো যে।
নানুর বাসার সাথের ছোট্ট পুকুরটায় তো খাল থেকে নৌকা নিয়ে চলে আসা যেত, কিন্তু আরও দুটো বড় পুকুর ছিল, পুব দিকে ভেতর বাড়ির পুকুর রান্নাঘর এর কাছে, আর পশ্চিমে বাহির বাড়ির পুকুর। লোহা কাঠের তক্তা দিয়ে ঘাট। পুকুরের ‘জান’ চেন নানুভাই? জান হলা ফাঁপা তাল গাছের কাণ্ড, পাড়ের নিচ দিয়ে পুকুর কে সংযোগ করত খাল এর সাথে, পাইপ এর মত। পুকুর ভরা ছিল মাছ। ‘জান’ এর মুখে একটা বাশের ফাঁদ থাকতো, বন্ধ করে দিলেই মাছ আটকা। আবার একটা সুপুরির ফাঁপা কাণ্ড ফেলে রাখা হত পুকুরে, শিং মাগুর এর মাঝে থাকতে পছন্দ করে। খপ করে ওটা উঠিয়ে ফেল্লেই মাছ! কি বোকা মাছগুলো তাই না? চালাক মাছগুলকে ধরত বড়শিতে ওস্তাদ ছোট মামা। বাহির পুকুরের পাড়ে ছিল ৭ টা জাম গাছ। বাড়ি ভরতি গাছপালা আম, জাম, লিচু, জামরুল, তবে কাঁঠাল কম ছিল। তাল আর খেজুর , নারিকেল সুপারি একটু কম।
কত কি যে করতাম, উঠানে জ্যোৎস্নাা রাতে সবাই মিলে ভুতের গল্প, শুকনোর সময়ে পাটখেতে লুকোচুরি, খেসারির শাক তোলা। তারপর খেয়ে দেয়ে ঘুমাতাম নানুর বাসার বারান্দায়। নারার ওপর হোগলা দিয়ে তার ওপর চাদর দিয়ে বিছানা।গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ফসল আমি দেখেছি নানুভাই।
কি ছিল না, হাঁস মুরগি তো বাদ ই দিলাম। স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল সেকালের লোকজন। এমনকি বড় ভোজ এর জন্য বাড়িতে একটা বিশাল হাড়ি ছিল। আমি ছোট ছিলাম দেখে আরও বিশাল লাগত হয়ত। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের সময় ওটা লুট করে নিয়ে যায় কারা যেন। ভাবছ এটা আবার এমন কি লুট করার? ওটা তো আজকালকার আলুমিনিয়াম এর হাড়ি না, মোটা পিতলের বিশাল হাড়ি, পিতলের বিষ দূর করতে নিকেলের কলাই করা থাকতো। সবার ছিল না যে এত দামি হাড়ি।
আরও কত কি হারিয়ে গেছে, বাড়ির পশ্চিমে এখন নানুদের কবরস্থান। ভাগাভাগি হয়ে আর এর কিছু নেই হয়ত। কত কাল যাওয়া হয়না, কিন্তু কিছুই ভুলিনি। তুমিও মনে রেখ নানু ভাই।
ইতি
তোমার নানু
প্রেরক: খানম রাশিদা নার্গিস
পরিশেষঃ
খানম রাশিদা নার্গিস এর পক্ষে চিঠিটি লিখেছেন তার সন্তান স্থপতি বিন সাঈদ বাখতী । এটা বাখতী -র মায়ের নানাবাড়ির স্মৃতি। মায়ের কাছ থেকে ফোনে শুনে লেখা। লেখিকা খানম রাশিদা নার্গিস এর নানা বহু আগে তার পৈতৃক বাড়ির পশ্চিমে নিজের এই বাড়ি করেন। পেশায় তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ম্যারেজ রেজিস্টার। বরগুনায় কাজ করতেন। ৩০-৪০ বছর চাকরির পর ফিরে আবার এখানে সপরিবারে থাকতেন। আশির দশকে সম্ভবত ভাগাভাগির পরে সবকিছু বদলে যায়। বড় হবার পরে নানা কাজের চাপে লেখিকার ওদিকে আর যাওয়া হয় নি ।
English Version| Translated by: Ismat Hossain
Dearest Nana Bhai,
Today I will tell you about my grandparents’ home. We used to live in Barisal but whenever we had summer holidays or winter break from school, we would head straight for Thakurmollick, my grandparents’ village. If we took a boat from the Notun Bazar Ghat in the morning, we could arrive there by afternoon. Sometimes Nanu himself would send a boat with a large awning made from one mallai bamboo. The boat would pass by numerous rivers and canals although I can only remember the names of the Arial Khan river and the Khoyrati khaal. The boat would ply through the canal and drop us at the small pond just adjacent to Nanu’s abode. We would climb over the roots of the huge Bel tree that embraced the banks and arrive straight into the courtyard.
The canal was towards the north and on the southern fringe was a road that connected the two villages on either side. The huge compound of Nanu’s house was snuggled in between these two. Beyond, on either side, stretched out the fields. Coming from the road you were greeted by the kachari ghor, a little further up was a grove of trees through which you would arrive upon the sizeable courtyard. On the north of the courtyard was Nanu’s beautiful hut made of tin and wood and just opposite to that was Boro Mama’s. On the eastern side of the courtyard was a large kitchen. The wood burning stove was placed at the eastern edge so that the smoke did not penetrate into the living quarters. There was also a huge dheki. There was a shaded verandah that lead you from the house to the kitchen on rainy days.
The primary harvest of the area was in the spring. A large granary stood towards the west of the courtyard. The granary was always teeming with yields from the crops. Beside the granary was a pigeon coop and behind that was the cow shed, probably placed farthest to keep the stench away. There would always be two pairs of bullocks that pulled the plough and a pair of milking cows. And of course there would be calves. Can you guess why there were two pairs of bullocks? So one pair could plough the fields while the other pair rested, of course.
I already mentioned the small adjoining pond that could be approached from the canal, but there were two much larger ponds as well. The one for the inner house was on the east near the kitchen and the one for public use was towards the west. The ghat was made with iron wood. Do you know what the ‘jaan’of a pond is, Nanu bhai? It’s the hollow trunk of a palm tree that runs underneath the banks of the pond like a pipe, connecting it to the canal. The pond was abundant with fish. There was a bamboo trap attached to the opening of the jaan. Once closed it would trap all the fish inside the pond. A hollow fallen betel nut tree trunk was left in the water for fish like Shing and Magur to inhabit. You could just raise the trunk and you would have all that fish. The poor, silly fish, don’t you think? My skillful Choto Mama caught the cleverer ones with his fishing rod. The outer pond was lined with seven jamun trees. The homestead was filled all kinds of trees in abundance-mango, jamun, lichee and jamrul. There were not so many jack-fruit trees though. Palms, dates, coconut and betel nut trees were also not so many in number.
We did so many things during our visits there, sharing ghost stories in the courtyard on moon lit nights, playing hide and seek among the jute stalks, picking khesari greens. After a full meal we would sleep on the verandah on sheets spread over beds made of hogla underlined with stalks of rice straw. I’ve seen so much abundance, Nanu bhai. Sheds full of cattle, granaries full of yields.
There was no scarcity of anything. Poultry and ducks were in plenty. People back then were so self-subsistent. We even had huge cauldrons for cooking up large feasts. Maybe it looked so grand because I was much smaller then. The cauldron was somehow stolen during the Liberation War. Are you wondering why anyone would want to steal a cauldron? This was not like the regular aluminum pots of today, it was a heavy bronze pot, coated with nickel to wane off the poison. Not everyone could own an expensive cauldron like that.
So much more has gotten lost over the years. My grandparents were buried on the western grounds of the homestead. Who knows what has happened since the property got subdivided. I have not been there for ages, yet I have not forgotten a thing. I hope my words continue to live in your memory, too.
From
Your Nanu
Sender: Khanum Rashida Nargis
Endnote:
The letter was written on behalf of Khanum Rashida Nargis by her son Architect Bin Sayeed Bakhti. These are Bakhti’s mother’s memories of her grandparents’ home. The description is set in the 1960’s. The location is Thakurmallik village under Babuganj zilla in Barisal. Bakhti’s great grandfather built this house on the west of his own paternal home many years ago. He was a marriage registrar under the British government. He was employed in Borguna. After working for 30-40 years he returned to live here with his family. The property was probably subdivided amongst the heirs during the 80’s, after which everything changed. Caught up in the intricacies of life, Bakhti’s mother never had the chance to re-visit after she grew up.
Glossary:
Nana Bhai: A term used to call one’s maternal grandfather. Here it is reversely used by the grandmother to address her grandson lovingly.
Nanu: A term referring to one’s maternal grandfather.
Mallai: Boatman
Arial Khan River: One of the main south-eastward outlets of the river Padma.
Khoyrati khaal: A well-known local Canal.
Bel: Also known as wood apple. A hard shelled round fruit with a thick and sticky flesh.
kachari ghor: A room presented at the front of the house usually used as a sitting room for greeting outsiders.
Boro Mama: Eldest among maternal uncles or ‘Mamas’’’.
Dheki: A traditional wooden device used for milling rice.
Ghat: A series of steps leading down to a body of water or wharf usually used for bathing.
Choto Mama: Youngest among maternal uncles or ‘Mamas’’’.
Khesari: Also known as blue sweet pea, a small lentil bearing plant. The greens are also consumed by locals.
Hogla: Local name for a bush-like small plant, Typha elephantiana of family Typhaceae. Extensively used to make mats and different kind of handicrafts.
হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।
আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।
বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/
ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com
Disclaimer:
CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website.