মূল চিঠি:
আদরের দাদুভাই,
প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের সাথে বরাবরই আমি গভীর আত্মিক সম্পর্কের টান অনুভব করি। শতাধিক আধুনিকতার দেয়ালে আবদ্ধ হয়েও কখনো নিজের শিকড় ভুলতে পারিনি। স্মৃতিকাতর মন আজ বড্ড শিকড়ের টান অনুভব করছে। সেই অনুভব থেকেই আজ তোমাকে আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য, ইতিহাস সম্পর্কে গল্প শোনাবো।
আজ তোমাকে আমার প্রাণপ্রিয় দাদুবাড়ির গল্প শোনাবো। কুষ্টিয়া জেলার,খোকসা থানার,শোমসপুর গ্রামে ছোট্ট একটি গ্রাম।ছায়াসুনিবিড়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমিতে ঘেরা গ্রামটিতে একান্নবর্তী পরিবারের বাস।চৌচালা টিনের বড় বাড়িটিই আমার দাদু বাড়ি।দাদুবাড়িতে যাবার কারণে মাটি,মানুষ ও প্রকৃতির একাত্মকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়।প্রতিবছর গ্রীষ্ম ও শীতের ছুটিতে আমি মা ও বাবার সাথে দাদুবাড়িতে যেতাম।বৃষ্টিতে ভিজে পুকুরে স্নান করা,কচু পাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টির জল আটকানোর চেষ্টা,শীতের সকালে খেঁজুর রস খাওয়া সব মিলে মধুর স্মৃতিগুলো আমাকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়।
সুবিশাল উঠানই ছিল দাদুবাড়ির অবকাঠামোগত প্রধান বৈশিষ্ট্য। উঠানকে কেন্দ্র করেই সব অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল ।উঠানের উত্তর ও পশ্চিম দিকে দুইটি বড় চৌচালা ঘর ছিল।একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হবার কারণে আলাদাভাবে দুটি প্রধান ঘর ছিল যাতে যথাক্রমে দুইটি ও তিনটি কক্ষ বিদ্যমান ছিল।চৌচালা গঠনই ঘর দুইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল।ঘরগুলোর বারান্দা অনেক বড় ছিল।বাসায় অতিথি এলে বারান্দায় শীতল পাটি বা খেঁজুর পাটি বিছিয়ে বসতে দেওয়া হতো।চাঁদনী রাতে সেই বারান্দাতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকতাম আর মা-দিদার সাথে গল্প করতাম।
সেসময় ঘরবাড়ির অবকাঠামোগত গঠন আজকালকার মতো আধুনিক ছিল না।দাদুবাড়ির মেঝে আধাপাকা ছিল।উত্তরদিকের ঘরের পাশেই ছিল হাঁস-মুরগির ঘর।পূর্বে অবস্থিত রান্নাঘরের টালি নির্মিত ছাউনি ছিল এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। রান্নাঘরের প্রায় সাথেই ছিল ঢেঁকিঘর যেখানে ধান,চাল ভানা হতো সেখানে বড় চুলা ছিল।চুলায় ধান,গম সহ শস্যাদি সিদ্ধ করা হতো। আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ।
রান্না ঘর থেকে সামান্য সামনে ছিল তুলশীবেদী যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সন্ধ্যাবাতি দেওয়া হতো।
বেদীর ঠিক পেছনেই ছিল ছোটো একটি জ্বালানিদ্রব্য রাখার ঘর।পাশেই ছিল একটা লেবু গাছ। লেবুগাছের পাশ ঘেষে পুকুরে যাবার একটি রাস্তা চলে গেছে।পথের পাশে দক্ষিণে ছিল একটি
গোয়াল ঘর।দাদুবাড়িতে আগে থেকেই হাঁস-মুরগী,গরু-ছাগল পালন করা হতো।পশ্চিমে প্রধান ঘর থেকে বেশ খানিকটা দুরেই ছিল শৌচাগার ও স্নানাগার।আগেকার দিনে শৌচাগার ও স্নানাগার সাধারণত প্রধান ঘর থেকে দূরে বানানো হতো।উঠানের এককোণে ছিল নলকূপ।প্রতিদিন বিকেল বেলা পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে আড্ডার আসর বসাতো।যেকোনো আনন্দানুষ্ঠানে পুরো উঠান জুড়ে আল্পনা আঁকা হতো।সেগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগতো।
শীতের সময় পুরো উঠান জুড়ে গাদা ফুল ফুটতো।ফুলের ঘ্রাণে পুরো বাড়ি মৌ মৌ করতো।নলকূপের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে যা সরাসরি প্রধান ফটকের সাথে সংযুক্ত হয়েছে।দাদুবাড়িতে সবথেকে আকর্ষণীয় জিনিস ছিল বহুপ্রাচীন শানে বাধানো সুবিশাল পুকুর।পশ্চিমে প্রধান ঘরের পেছনে ছিল একটা ডোবা।ডোবায় প্রচুর শাপলা ফুল ফুটতো।ডোবা ও পুকুরে প্রচুর মাছ ছিল। আমি বর্শি দিয়ে মাছ ধরতাম।পুকুরে সাঁতার কাটতাম।পুকুরের তিনপাশে যথাক্রমে স্কুল,জমি ও আখ ভাঙানোর যন্ত্র ছিল। জমিতে দাদুরা শস্য ও সবজি চাষ করতো।আর আখ ভাঙানোর যন্ত্রে আখের রস থেকে গুড় বানানো হতো।শীতের সময় দাদু বাড়িতে গেলে আখের রস,গরম গুড় খেতাম।শীতের রাতে জমির মাঝে শেয়ালের ডাক শোনা যেত।গ্রীষ্মে চাঁদনী রাতে বাঁশ বাগানের দিকে তাকালে ভয়ে বুকটা কেপে উঠতো শুধু মনে হতো সেখানে ভুত প্রেতের বাস।সেসকল অনুভুতি ছিল অতুলনীয়।
দাদু বাড়িতে গেলে দিদা পিঠাপুলি,আম-দুধ,কলা,পান্তা ইলিশ,কাচা আম-পেয়ারা-জাম মাখানো,আমসত্ত্ব,কলার মোচা রান্না খেতে দিতো।হারিয়ে গেছে সেসব সোনালী দিনগুলো।
যান্ত্রিকতার ভিড়ে, হাজার টা দেয়ালে আবদ্ধ জীবনে আজকাল আর সেই প্রকৃতির স্পর্শ অনুভব করতে পারিনা।বাঙালির ঘরবাড়ি সহ সকল অবকাঠামোগুলোর নিদারুন পরিবর্তন এসেছে। আধুনিকতার যুগে সোনালী অতীতের বুলি আওড়িয়ে সেসকল না জানা কথাগুলোর জানান দিলাম তোমাকে। আশা করি আমার বর্ণনা ও আঁকানো ছবি দেখে আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পেরেছো।আশা রাখি খুব শীঘ্রই তোমাকে নিয়ে আমার প্রাণপ্রিয় ভিটেমাটিতে একদিন উপস্থিত হবো।
ইতি
দিদিভাই
প্রেরক: ঋতুশ্রী মদক সাথী
অন্যান্য তথ্য:
এলাকার নামঃ খোকসা, কুষ্টিয়া
পূর্বপুরুষের তথ্য: সন্ন্যাসী পরিবার ।
নির্মাণকাল: উনিশ শতক
English Version | Translated by Amit Imtiaz
Dearest Dadubhai,
I have always felt a deep spiritual connection with nature, landscape, and people. However, I was confined to the enclosure of modernity but I could never forget my roots. Today my mind is burdened with old memories and feeling the urge to go back to the roots. Those feelings today drove me to tell you the story about the history and heritage of our ancestors.
Today I will tell you the story of my beloved “Dadubari” (grandfather’s house). It’s a small village in Shomaspur village of Khoksathana in Kushtia district. It was a land of natural beauty, occupied with joint families. The giant house with “chauchala(thatched house with four roofs)” roof was my grandfathers’ house. Going to Dadubari was an opportunity to see the landscape, people, and most importantly nature closely. Every year I used to go to Dadubari with my mother and father during summer and winter vacation. We used to take bath in the pond completely drenched in the rain, even we used to try to stop the rainwater with the leaves of kachu (Taro), drinking date juice in the winter morning; all these sweet memories move me intensely.
The vast courtyard was the main infrastructural feature of Dadubari. All the other structures were built around the courtyard. To the north and west of the courtyard, there were two large chauchala (thatched house with four roofs) houses. Due to a large number of members of the joint family, there were two main rooms separately with two and three rooms respectively. The main feature of the two houses was the structure of the chauchala (thatched house with four roofs). The verandahs of the houses were very large. When guests came to the house, they were allowed to sit on the verandah with a cool mat or Shital-Pati (a kind of mat that feels cold by nature)or a mat made of date leaves. On a moonlit night, I would lie on the verandah and talk to my mother and grandmother.
At that time the infrastructural structure of the house was not as modern as of today. The floor of the grandfather’s house was Semi puka. Next to the house on the north side, there was a small chicken house. The tiled canopy of the kitchen on the south was its special feature which was very interesting to see. Almost next to the kitchen, there was a Dhekighar ( Dheki is an agricultural tool used for threshing to extract rice grains from their outer husks while leaving the bran layer to produce brown rice; Dhekighar is where a Dheki is located). There was this large burner called Chulha. Grain, wheat, and other grains were boiled in the Chulha (a U-shaped mud stove made from local clay). The main occupation of our ancestors was agriculture.
A little far from the kitchen, there was a ‘Tulsibedi” (it’s an altar or a raised platform where a tulsi tree is planted) and where the evening lamp was lit every evening. Just behind the altar, there was a small fuel storage room. Next to it, there was a lemon tree. Alongside the lemon tree, there was a road leading to the pond. There was a barn on the south side of the path. Poultry, cows, and goats were already reared in my Dadubari. To the west, not far from the main house, were the toilets and baths. In earlier days toilets and bathrooms were usually built away from the main house. There was a tube well in one corner of the courtyard. Every afternoon the neighbors would come and have a chat. Alpana (a form of painting with colorful motifs that are done with hands-on auspicious occasions in Bengal) was painted all over the courtyard for various occasions. They looked so beautiful.
During the winter, Marigold flowers bloomed all over the court. The whole house was flooded with the scent of flowers. A road has passed by the side of the tube well which is directly connected to the main gate. The most interesting thing about Dadubari was the huge pond built with dilapidated steps. To the west, there was a shallow puddle behind the main house. It was filled with water lilies. There were lots of fish in the puddles and ponds. I used to have fun catching fish with a spear. I used to swim in the pond. On three sides of the pond were a school, abundant land, and sugarcane threshing machines respectively. Grandfathers used to cultivate grains and vegetables in the land. Delicious molasses were made from sugarcane juice in a sugarcane threshing machine. During the winters, I used to eat sugarcane juice and hot molasses in Dadubari. On winter nights, you would listen to foxes faraway. Summer moonlit night had a great illusion on the bamboo garden, looking at them made me tremble with fear as I used to believe ghosts were living there. All those feelings were incomparable to any other feeling in this world.
While visiting my grandfathers’ house we used to enjoy cakes, mango milk, bananas, Panta- Elish (traditional Bengali food including wet rice served with Hilsha fish fry), raw mangoes, guava, Jaam (Syzygium cumini-Black plum), Amshotto (sun-dried mango pulp mixed with sugar), cooked Kolar Mocha (cone of banana) and whatnot. Those golden days are lost. In this crowded monotonous mechanical lifestyle confined with thousand walls, we grew apart from nature. All the infrastructures, including the houses of the Bengalis, have seen the face change drastically. In this modern time, I have shared and uttered the words of these unknown things of our golden past. I hope you have found out a little bit about the history of our ancestors by looking at my descriptions and drawings. I hope to visit my beloved land one day with you soon.
Yours,
Didivai
Other information:
Name: Ritusree Modok Sathi
University: Hajee Mohammad Danesh Science and Technology University (HSTU),
Dinajpur -5200
Department: Architecture,
Level-1, Semester- l
Age: 21
Occupation: Student
Place of Origin: Khoksha,Kushtia
Information of Ancestors: Sonnyashi Family
Time of Establishment: 19th Century.
হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম। হারিয়ে যাচ্ছে মাটি ও মানুষের আত্মিক সম্পর্ক। জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের শেকড়। গ্রামের বাড়ি আজ যেন এক নস্টালজিয়া। শুধু বেঁচে আছে আমাদের স্মৃতিতে। কি রেখে যাচ্ছি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে? সেই শিকড়ের খোঁজে আমরা খোলা চিঠির আহ্বান জানিয়েছিলাম।
আপনি যদি অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে থাকেন তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটি প্রেরণ করুন।
বিস্তারিতঃ http://localhost/context/events/event/basatbari/
ইমেইল: boshotbari.context@gmail.com; context.editor4@gmail.com
Disclaimer:
CONTEXT (www.contextbd.com) and their collaborators jointly hold the copyrights of all contents including, but not limited to, all text, information, illustrations, images. You may not duplicate or reproduce any of the content on this website, including files downloadable from this website.