“স্থান, কাল এবং অস্তিত্ব” – আরাতা ইসোজাকি | Space, Time and Existence – Arata Isozaki

11 May, 2019 Total View: 24

Illustration by Ziaur Rahman Ovi

(আরাতা ইসোজাকি একজন জাপানী স্থপতি। বর্তমান সময়ে যেসব স্থপতি সারা বিশ্বে তাদের কাজের মাধ্যমে স্থাপত্য অঙ্গনে অবদান রেখে চলেছেন, জনাব ইসোজাকি তাদের মধ্যে অন্যতম। কোন একটি নির্দিষ্ট স্টাইলের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে প্রত্যেকটি প্রজেক্টকে আলাদা কনটেক্সট অনুযায়ী বিবেচনা করে কাজ করার জন্যে তিনি সুপরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে অইতা মেডিকেল হল (১৯৬০), ফুজিমি কান্ট্রি ক্লাব (১৯৭৩-৭৪), কিতাকিয়োশো সেন্ট্রাল লাইব্রেরি (১৯৭৩-৭৪), আর্ট টাওয়ার অব মিতো (১৯৮৬-৯০), দোমাস কাসা দেল হম্ব্রে (১৯৯১-৯৫) ইত্যাদি। জনাব ইসোজাকি তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৬ সালে RIBA গোল্ড মেডেল এবং ২০১৯ সালে Pritzker প্রাইজ লাভ করেন।)

শব্দহীন নীরবতা অনুভব করার চেষ্টা করেছেন কখনো? একদম সুনশান নিঃস্তব্ধতা? সত্যি বলতে কি, নীরবতার ভাষাই সবচেয়ে সুন্দর। এবং, নিরেট শূণ্যতার মধ্যেই আমি খুঁজে পাই পরিপূর্ণ ঐশ্বর্য; যা আমাকে অস্তিত্বের মাহাত্ম্য অনুভব করতে শেখায়।

স্থান, কাল ও অস্তিত্ব

ধরুন, আপনি একটি চলচ্চিত্র তৈরি করতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে আপনি কি করবেন? প্রথমত, আপনার চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহ থাকতে হবে। ক্যামেরা নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান কিংবা কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এবং অতি অবশ্যই আপনার মাথায় একটি গল্প থাকতে হবে; যে গল্পটি আপনি বলতে চান।

কিন্তু, কাজ শুরু করে দেয়ার পর এক পর্যায়ে হয়ত দেখবেন যে, বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন আইডিয়া একের পর এক আপনার মাথায় আসা শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দুইটি ঘটনা ঘটতে পারে। হয়, আপনার মাথায় সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাবে। অথবা, আপনার গল্পটি ঈষৎ পরিমার্জিত হয়ে আগের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এক্ষেত্রে আপনাকে ঠান্ডা মাথায় সুস্থির চিত্তে সূক্ষ্ম কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যার উপর আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। আপনি যদি আইডিয়ার ভীড়ে হারিয়ে যান, তাহলে আপনার চলচ্চিত্র কখনো আলোর মুখ দেখবেনা।

এই যে তাৎক্ষণিক বিচক্ষণতা, যা আপনাকে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করবে, অর্থাৎ, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করবে- আমি মনে করি, একজন শিল্পী বা নির্মাতার জন্য এই বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

কালবিহীন স্থান
যেকোন সৃজনশীল কাজে ‘স্থান’ (Space) এবং ‘কাল’ (Time) এর প্রাসঙ্গিকতা এবং গুরুত্ব অপরিহার্য। কিন্তু, কেবল স্থান আর কালের সমীকরণই সবকিছুকে পূর্ণতা দিতে পারে না। আমাদের জাপানী দর্শনে “মা” (ma/閒) নামে একটি কনসেপ্ট আছে, যা দ্বারা পাশাপাশি দুটি বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত স্থানটিকে বুঝায়। ধরুন, দুইটি বস্তুকে পরস্পরের সংস্পর্শে পাশাপাশি রাখা হলো। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যে এদের মধ্যে কোন ফাকা স্থান নেই। কিন্তু আসলেই কি তাই? না। আপনি যত কাছেই দুটো বস্তুকে রাখুন না কেনো, তারা কখনো এক হয়ে যাবেনা। তাদের মধ্যে অবশ্যই কিছুটা শূণ্যস্থান থাকবে। যেটা হয়তো আপনি খালি চোখে দেখতে পাবেন না। আপনাকে এই স্পেইসটা অনুভব করতে হবে। দুইটি বস্তু বা উপাদানের বাহ্যিক অস্তিত্বের মধ্যে বিরাজমান অদৃশ্য এই শূণ্যস্থানকেই জাপানী দর্শনে ‘মা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

সহজভাবে বুঝার জন্যে আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আমরা কথা বলার সময় দুইটি শব্দ বলার ফাকে অল্প কিছুক্ষণের জন্যে থামি; অর্থাৎ, বিরতি নেই। কারণ, স্বল্পস্থায়ী এই নিঃশব্দতা দুটি শব্দের আলাদা অস্তিত্বকে জোরদার করে। কেউ যখন থেমে থেমে প্রতিটি শব্দকে আলাদাভাবে উচ্চারণ করে কথা বলে তখন আমরা স্পষ্টভাবে তার বক্তব্য বুঝতে পারি। দুটো শব্দের অন্তর্বর্তী এই নিঃশব্দকালই ‘মা’।

আমাদের এটা মনে রাখতে হবে, আনুষঙ্গিক প্রেক্ষাপটে “স্থান” বা “স্পেইস” (space) এর সমীকরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ; যেহেতু, স্পেইস তৈরি করাই আমাদের স্থপতিদের কাজের মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু, অন্তঃস্থ শূণ্যস্থান বা ‘মা’ তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘মা’ এর দৃশ্যমান বাহ্যিক অস্তিত্ব না থাকলেও, বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের সবকিছুর মধ্যেই এর উপস্থিতি রয়েছে। আমরাও জেনে বা না জেনেই সর্বক্ষেত্রে এর ব্যবহার করে থাকি। কারণ,অন্তঃস্থ স্থান ছাড়া পারিপার্শ্বিক স্থান বা স্পেইসকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায়না, এবং স্পেইসের অস্তিত্বই অসার ও মূল্যহীন হয়ে পরে।

স্টাইলেই সমাধান?
আমি সবসময় নতুন কিছু তৈরি করতে চাই। তাই পরপর দুটো কাজ এক রকম হোক, সেটা আমি চাই না। নতুন এবং অনন্য কিছু সৃষ্টির মধ্যেই আমার আনন্দ। যারা সবসময় কোন ব্যক্তির কাজের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ধারা বা বৈশিষ্ট্য খুজতে চান, তারা হয়ত আমার কাজে হতাশ হবেন। কারণ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্টাইলের প্রচলিত এই রীতিতে আমি বিশ্বাসী নই। আমি মনে করি না যে আমাকে সবসময় কোন অভিন্ন রীতি অনুযায়ী কাজ করতে হবে। বরং আমার প্রত্যেকটি কাজ হবে স্বকীয়, অনন্য; যা আমার নিজস্ব ধারা হিসেবে বিবেচিত হবে।

আমি নির্দিষ্ট কোন স্টাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। আমি চাই সংশ্লিষ্ট পরিবেশ, পরিস্থিতি, এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়াদির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কাজ করতে। এছাড়াও আমি মনে করি, পরিবেশ ও পরিস্থিতির ভিন্নতা অনুযায়ী উদ্ভত একগুচ্ছ সমস্যাকে স্থাপত্যের জ্ঞানের নিরীখে সমাধান করাই স্থপতিদের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। এবং বলাবাহুল্য, এ ধরনের কনটেক্সটনির্ভর এবং নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানভিত্তিক স্থাপত্য প্রত্যেকটি প্রজেক্টের জন্য অবশ্যই আলাদা হবে।

একটি দ্বীপমাত্র!
ভৌগোলিকভাবে জাপান একটি দ্বীপরাষ্ট্র। অর্থাৎ, সমগ্র পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে, সূর্যোদয়ের দেশটি সাগরের মধ্যে ভাসমান একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ মাত্র। তাই, আমি মাঝে মাঝেই আমাদের জাপানী সত্তার সীমারেখা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কিন্তু, আদৌ কি এর কোন সীমানা আছে?একটি দ্বীপের কি তথাকথিত সীমানা থাকতে পারে? চারদিকে তো অথৈ জলরাশি! প্রকৃত কোন সীমানা বা দেয়ালের কোন অস্তিত্ব তো নেই।

তবে ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা জানতে পারি যে, বিগত কয়েক হাজার বছরে বহুবার আমরা আমাদের অনন্য জাপানী স্টাইল তৈরি করতে পেরেছি, যা সারাবিশ্ব থেকে আলাদা; একান্তই আমাদের নিজস্ব। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিশেষ করে সত্তরের দশকের পর থেকে আমরা আমাদের নিজস্ব জগতের গণ্ডি থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছি। আমরা এখন বাহিরের অন্যান্য জাতি ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হচ্ছি, তাদের সাথে আমাদের মিথস্ক্রিয়া ঘটছে। আমরা বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জানতে পারছি, এবং বহির্বিশ্বও আমাদের সম্পর্কে আগের চেয়ে ভালোভাবে জানতে পারছে। এই যে পারস্পরিক সম্পর্কের আদান প্রদান, এটা এর আগে কখনো হয়নি।

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, সবকিছুর পরেও আমাদের একটা নিজস্ব জাপানী ‘ধারা’ (style) রয়েছে; যা জাতি হিসেবে আমাদের সার্বজনীন চিন্তা- চেতনা এবং আদর্শের প্রতিফলন ঘটায়। কিন্তু, এটি আসলে সমষ্টিগত কিছু ধ্যান-ধারণা এবং সমন্বিত রুচিবোধের প্রতিচ্ছবি। এই ধারার আলাদা কোন বিশেষ অর্থ নেই, যদি না সংশ্লিষ্ট এই বিষয়গুলোকে গভীরভাবে অনুধাবন করা যায়। এক কথায় বলতে গেলে, একটি জাতির সামগ্রীক রুচিবোধ এবং এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আবহ সেই জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচায়ক; এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতিসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এর কোন বিকল্প নেই।


About the Author(s): 

Mahin is a passionate writer and architecture graduate from Shahjalal University of Engineering and Technology (SUST), Sylhet, Bangladesh.  Mahin’s blog:  https://mahinique.wordpress.com

Ziaur is a rising digital artist and architecture student of SUST. Ziaur’s blog : https://www.artstation.com/ziaurovi

Small_5 years _ post footer

ABOUT THE AUTHOR

ARTICLES BY THE AUTHOR

PEOPLE ALSO VIEW