স্থাপত্য ও আমার ভাবনা – কেনগো কুমা (Architectural Deliberation of Kengo Kuma)

4 December, 2019 Total View: 29

Illustration by Ziaur Rahman Ovi

স্থাপত্য এমন একটি বিচিত্র মাধ্যম যা নিঃশব্দে আমাদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে। সুন্দর কোন স্থাপনা দেখলে আমরা নিজেদের অজান্তেই তার প্রতি আকৃষ্ট হই। আর, একজন স্থপতি হচ্ছেন সেই ব্যক্তিত্ব যিনি তার কাজের মাধ্যমে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন।

শুরুর গল্প; গল্পের শুরু

যখনই আমি কোন নতুন প্রজেক্ট শুরু করি, আমার সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে সেই প্রজেক্টের জমির  উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো। যাতে আমি জায়গাটার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও আনুষঙ্গিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারি। আমি মনে করি, প্রত্যেকটি জায়গার একটি নিজস্ব গল্প থাকে। একজন স্থপতি হিসেবে আমার সেই গল্পটা বুঝার চেষ্টা করতে হবে। আর এজন্যে আমাকে অবশ্যই সেখানে হাঁটতে হবে- নিজের পায়ে সেই জায়গার মাটি স্পর্শ করতে হবে; নিজের হাতে সেখানকার গাছগুলো ছুঁয়ে দেখতে হবে; গাছের পাতাগুলো অনুভব করতে হবে। এর মাধ্যমে জায়গাটার সাথে আমার কথোপকথন হবে, বোঝাপড়া হবে এবং সর্বোপরি আমি বুঝতে পারবো এই জায়গার মাটি কি চায়; এবং আমার প্রজেক্টটি ঐ চাহিদার প্রেক্ষাপটে কিভাবে শুরু করতে হবে।

স্থাপত্যে প্রজ্ঞা ও কৌশল

আমার ডিজাইনের দর্শণ বা মূল লক্ষ্য হচ্ছে এমন ধরনের স্পেইস (space) তৈরি করা যেখানে প্রকৃতির সাথে মানুষের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হবে; এবং যেখানে মানুষ বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। সত্যি কথা বলতে, হাইরাইজ বিল্ডিং বা সুউচ্চ বহুতল ভবনের প্রতি আমার আগ্রহটা একটু কম। বর্তমান সময়ে টোকিও থেকে শুরু করে বিশ্বের যে কোন শহরে ঢালাওভাবে বহুতল ভবনের উপস্থিতিকে আধুনিকতার অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ, আমার কাছে এ ধরনের স্থাপনাগুলোকে শহুরে জঞ্জাল মনে হয়, যা বিগত বিংশ শতাব্দীর প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। একটা সময় ছিলো, যখন জায়গার সংকটের কারণে শহরকে সম্প্রসারণ করার জন্য বহুতল ভবন নির্মাণের কোন বিকল্প ছিলোনা। কিন্তু আমি মনে করি, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে উর্ধ্বমুখী নগর সম্প্রসারণের এই ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। মানুষ এখন আকাশ দেখতে চায়; বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি লো-রাইজ বিল্ডিং বা কম উচ্চতাবিশিষ্ট স্থাপনার প্রতি আগ্রহী, যেগুলো মাটির খুব কাছাকাছি থাকবে এবং স্থানীয় ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে তৈরি হবে। ফলে প্রত্যেকটা শহরের একটা আলাদা নিজস্ব ইমেজ বা স্বরূপ গড়ে উঠবে; এবং কালের বিবর্তনে স্থাপনাসমূহ ঐ শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে।

ভৌগোলিকভাবে জাপানকে ভূমিকম্পের দেশ বলা হয়। তা সত্ত্বেও, আমাদের গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে স্থানীয় রাজমিস্ত্রীরা হাজার বছর ধরে নিজস্ব কৌশল ও উপকরণ ব্যবহার করে এমনভাবে তাদের বাসস্থান তৈরি করেন, যা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাতেও যুগের পর যুগ টিকে থাকে। নির্মাণশিল্পের এই আদি ও অনন্য কৌশল আয়ত্ত্ব করার লক্ষ্যে পেশাগত জীবনের একটা পর্যায়ে আমি গ্রামে চলে যাই। সেখানে আমি স্থানীয় মানুষদের সাথে থেকে তাদের চালচলন-জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখি, এবং তাদের কাছ থেকে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে বাড়িঘর নির্মানের যে সহজ কৌশল, তা শিখি। পরবর্তীতে আমি আমার পেশাগত জীবনে বিভিন্ন প্রজেক্টে এবং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই কৌশলসমূহ প্রয়োগ করার চেষ্টা করি; যা সন্দেহাতীতভাবে আমার ব্যক্তিগত জীবন ও দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

উপকরণভিত্তিক সমাধান

বিজ্ঞাণ ও প্রযুক্তির এই যুগে শহুরে যান্ত্রিক জীবনে মানুষ হাপিয়ে উঠেছে। এখন বেশিরভাগ মানুষ ইট-কনক্রিটের বেড়াজালে আবদ্ধ না থেকে নির্মল প্রকৃতি ও মুক্ত বাতাসের সান্নিধ্যে থাকতে চায়। প্রকৃতি ও মানুষের এই সহজাত সংস্পর্শের কথা মাথায় রেখে আমি আমার ডিজাইনে কাঠ ও বাঁশের মত প্রাকৃতিক ও সহজলভ্য উপকরণ ব্যবহার করার চেষ্টা করি। যাতে স্থাপত্য ও তার পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির মধ্যকার দূরত্বকে যথাসম্ভব কমিয়ে এনে- একে অপরের পরিপূরক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়।

আর এ ধরনের প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহারের কিছু প্রায়োগিক সুবিধাও আছে। যেমন, কাঠ বা বাঁশের তৈরি কোন স্থাপনায় আপনি কোন একটা অংশ পরিবর্তন করতে চাইলে, খুব সহজেই শুধুমাত্র ওই নির্দিষ্ট অংশের কাঠ বা বাঁশের টুকরাটি খুলে নতুন আরেকটি টুকরা দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে পারবেন। অথচ, কংক্রিটের তৈরি কোন স্থাপনায় এভাবে ক্ষুদ্র অংশ প্রতিস্থাপনের কোন সুযোগ নেই। সেখানে পরিবর্তন মানেই হলো সম্পূর্ণ স্থাপনাটিকে ভেঙ্গে নতুনভাবে পুনঃনির্মাণ করা,  যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।

স্কেইল ও সৌন্দর্য্য

আমি যেকোন স্কেইলের স্থাপনা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। সেটা ৩২ বর্গফুটের ছোট্ট টং দোকান কিংবা ২০২০ অলিম্পিকের জন্য প্রস্তাবিত নতুন জাতীয় স্টেডিয়াম যেটাই হোক না কেনো! প্রস্তাবিত স্টেডিয়ামটি নিঃসন্দেহে একটি সুবিশাল স্থাপনা। তাই আমার নিজস্ব দর্শন অনুযায়ী স্টেডিয়ামের মত একটি বিশাল স্থাপনা দাড় করানো আমার জন্য সত্যিই অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যেও আমি চেষ্টা করেছি স্টেডিয়ামটিকে যতটা সম্ভব হালকা করার! এখানে আগে যে স্টেডিয়ামটি ছিলো তার উচ্চতা ছিলো ৬০ মিটারের বেশী। আমি আমার ডিজাইনে এর উচ্চতা কমিয়ে ৫০ মিটারের মধ্যে নিয়ে এসেছি। এছাড়াও এখানে আমি স্টেডিয়ামটির বাহ্যিক অভিব্যক্তিতে উল্লম্ব অভিব্যক্তির (vertical expression) পরিবর্তে আনুভূমিক অভিব্যক্তি (horizontal expression) আনার চেষ্টা করেছি। আর স্থাপনাটির প্রধান উপকরণ হিসেবে কনক্রিট বা ইটের পরিবর্তে বেছে নিয়েছি কাঠ। এমনকি প্রধান স্ট্রাকচারাল অংশগুলোকে আমি ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ করে সেখানে কাঠের পাত ব্যবহারের মাধ্যমে পুরো স্থাপনাটিকে দাড় করিয়েছি।

আমি আমার ডিজাইনে তাক লাগানোর মতো কিছু করতে চাইনা; কারণ চোখ ধাধানো বা মন মাতানো কিছু করা আমার কাজের লক্ষ্য নয়। ফর্ম (form) কেন্দ্রিক ডিজাইনের প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো তা স্থাপনার ম্যাটারিয়েল বা উপকরণের অকৃত্রিম সৌন্দর্য্যকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়। তাই, ফর্ম নাকি উপকরণ কোনটাতে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত- এধরনের বিতর্ক আমি সবসময় এড়িয়ে চলি। ব্যক্তিগতভাবে আমি ফর্মের অনাড়ম্বরতায় বিশ্বাসী। আমি চাই খুব সাধারণ ফর্মের মধ্যে ম্যাটারিয়েলের ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করতে। কারণ আমি মনে করি, সৌন্দর্য্য শুধু ফর্ম বা মাসিং এর জৌলুসের উপর নির্ভর করেনা; বরং, কোন স্থাপনার ফর্মকে যথাসম্ভব সূক্ষ্ম রেখে, তার ম্যাটারিয়েলের গুণগত বৈশিষ্ট্য যত বেশি প্রকাশ করা যাবে, আমার মতে সেই স্থাপনা তত বেশি সুন্দর হবে।

স্থাপত্য; কিংবা সময়ের প্রতিচ্ছবি

সময়ের প্রেক্ষাপটে স্থান ও অবস্থানের সংজ্ঞা সর্বদা পরিবর্তনশীল। আমরা চাইলেও সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। কথায় বলে, সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। সময় সর্বদা গতিশীল। আর, সময়ের সাথে সাথে স্থাপত্যের পরিবর্তনও অবশ্যম্ভাবী। এক সময় এই নশ্বর পৃথিবীতে আমি, আপনি বা আমরা কেউ থাকবোনা; অথচ কালের সাক্ষী হয়ে যুগের পর যুগ টিকে থাকবে আমাদের স্থাপত্য! এক্ষেত্রে আমরা আমাদের স্থাপনাসমূহকে কালের নিদর্শন হিসেবে তৈরি করতে পারি; যাতে সময় ও স্থাপত্য একে অপরের পরিপূরক হয়ে একটি একক স্বত্ত্বায় পরিণত হয়; এবং অদূর ভবিষ্যতে আমাদের তৈরি স্থাপনাসমূহ বর্তমান এই সময়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।

যদি আমরা স্থাপত্যকে সময়ের প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই স্থাপত্যচর্চার কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই আমাদেরকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে মাটির কাছে ফিরে আসতে হবে; খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই।

Source:

  1. How Sustainability Is Bringing Architecture Back Down to Earth by Great Big Story
  2. Kengo Kuma – Time Space Existence

 


 

About the Author(s): 

Mahin is a passionate writer and architecture graduate from Shahjalal University of Engineering and Technology (SUST), Sylhet, Bangladesh.  Mahin’s blog:  https://mahinique.wordpress.com

Ziaur is a rising digital artist and architecture student of SUST. Ziaur’s blog : https://www.artstation.com/ziaurovi


 

ABOUT THE AUTHOR

ARTICLES BY THE AUTHOR

PEOPLE ALSO VIEW