স্থান, কাল ও অস্তিত্ব – বালকৃষ্ণ দোশি | Time, Space & Existence – Balkrishna Doshi

4 May, 2020 Total View: 39

Illustration by Ziaur Rahman Ovi

‘অস্তিত্ব’ কী?

এ এক জটিল প্রশ্ন; যার সরাসরি উত্তর দেয়াটা কঠিন। তবে আমার মতে, অস্তিত্ব হলো আমাদের যাবতীয় মানবিক আবেগের এক ধরনের সামগ্রীক বহিঃপ্রকাশ। একে কোন শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আমার চোখ চারপাশের পৃথিবীটা সম্পর্কে আমাকে বলছে, আমার কান তা শুনছে। কিন্তু আমি কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো যে ‘আমি’ এখানে অবস্থান করছি কিনা? ‘আমি’ বা ‘আমার’ ব্যাপ্তিই বা কতটুকু! আমার অস্তিত্ব, আমার নিজস্ব সত্ত্বা কি তাহলে শুধুমাত্র আমার ইন্দ্রীয়ের কার্যকারিতার উপর নির্ভরশীল? চোখ বন্ধ করলে ‘আমার’ অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে না তো? এসব প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর নেই। “অস্তিত্ব” কেবলই একটি অনুভূতি।

স্থাপত্য এমন একটি মাধ্যম যা আমাদের মনের ভাব, আবেগ ও অনুভূতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। আমি যখন কোন স্থাপনা তৈরি করি, তখন আমার প্রধান লক্ষ্য থাকে এমন একটি ঘরোয়া পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে আপনি আপনার নিজের বাড়িতে থাকার মতো মানসিক প্রশান্তি লাভ করবেন; এবং আমার এই ঘরটিকে আপনার কাছে আপন মনে হবে। কারণ, নিজের ঘরে বা নিজের বাড়িতে থাকার যে তৃপ্তি বা আনন্দ, সেটা একটি স্বর্গীয় ব্যাপার! এবং মানুষ যেখানেই যাক, যত দূরেই যাক, অবচেতন মনে নিজের ঘরে থাকার এই স্বর্গীয় অনুভূতিটি সে সর্বত্র খুজে বেড়ায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, আজকের দিনে আমরা নিজের ঘরে বাস করার সেই প্রিয় অনুভূতিটি ভুলে যেতে বসেছি। কারণ, ঘরোয়া পরিবেশের অকৃত্রিম মাহাত্ম্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

‘ঘর’ থেকে শিক্ষা

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে, একজন মানুষের কাছে তার নিজের বাড়ি সবচেয়ে মূল্যবান; সবচেয়ে আপন। এটা শুধু তার আশ্রয়স্থল বা মাথা গোজার ঠাই নয়; বরং এটি তার অস্তিত্বের অংশ, তার একান্ত নিবাস। বাড়ি এমন একটি জায়গা যেখানে সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্ম হয়, মনুষ্যত্ববোধের সূচনা ঘটে, এবং সর্বোপরি জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। জীবনের সূচনালগ্ন থেকে একজন মানুষ সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সহনশীলতা ইত্যাদি সমস্ত মানবিক গুণাবলি এবং মূল্যবোধ অর্জনের প্রাথমিক হাতেখড়ি লাভ করে তার নিজের বাড়ি থেকে। আর যথার্থ পারিবারিক শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ তার নিজস্ব সত্তা ও ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করার মাধ্যমে নিজের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে।

ভারতীয় বাড়ি সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি আমি খেয়াল করেছি তা হলো, স্পেইসের রূপান্তর। যে কোন বাড়ির অন্দরমহল একাধিক স্পেইসের পারস্পরিক সহাবস্থানের মাধ্যমে গঠিত হয়। যেমন, ব্যক্তিগত জায়গা, সর্বজনীন জায়গা কিংবা আধ্যাত্মিক জায়গা। ভিন্নধর্মী এই স্পেইসগুলো যেমন একে অপরকে আলাদা করে, আবার কখনো কখনো পরস্পরকে যুক্তও করে। ক্ষেত্রবিশেষে, একটি নির্দিষ্ট জায়গার একাধিক ব্যবহারও থাকতে পারে। বিশ্বাস বা প্রথার রীতি অনুযায়ী কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে পবিত্র স্থান হিসেবে ব্যবহার করার মাধ্যমে একে আধ্যাত্মিক রূপ দেয়া যায়। আবার উপলক্ষ্য শেষ হয়ে গেলে সেই বিশেষ জায়গাটিকেই আবার অতীব সাধারণ কাজে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ, উদ্দেশ্যের সূক্ষ্ম তারতম্যের কারণে সাধারণ একটি জায়গা নিমিষেই অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। জীবনের অপার স্নিগ্ধতা আর বৈচিত্র্য এখানেই!

আমি মনে করি, গৃহ অভ্যন্তরে স্পেইসের রূপান্তরের এই দর্শন আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। এবং আমার যে কোন কাজে ফর্ম ও কাঠামোর সাথে স্পেইসের আন্তঃসম্পর্কে এর প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে।

গুরু এবং যোগী

স্থাপত্যের সাথে আমার পরিচয় কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং এটি আমার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শৈশব থেকে অনেকটা নিজের মনের অজান্তেই স্থাপত্যের সাথে আমার যোগসূত্র ঘটে। ব্যক্তিজীবনে স্থাপত্যের কঠিন তত্ত্ব বা সূত্রগুলো আমি কখনো শিখার চেষ্টা করিনি; বরং আমি সেই প্রক্রিয়াটি শিখেছি যার মাধ্যমে স্থাপত্যের অবিরাম বিবর্তন বা পরিবর্তন সহজে বুঝতে পারবো; এবং জীবনের যে কোন পর্যায়ে তা কাজে লাগাতে পারবো।

পেশাগত জীবনে আমি প্রথম যে কাজটি করি তা ছিলো একটি গ্রামীণ হাউজিং। এই প্রজেক্টে কাজ করার সময় আমাকে পল্লীজীবন নিয়ে ভাবতে হয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় আমি গ্রামের সহজ সরল সাধারণ মানুষের সাথে মিশেছি; এবং তাদের সাথে তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে কথা বলেছি। আর খুব কাছ থেকে দেখেছি কিভাবে মানুষ একখণ্ড কৃষিজমি, কয়েকটি গবাদি পশু আর মাথার উপরে এক টুকরো ছাদকে অবলম্বন করে তার সংসার সাজায়, এবং পুরো জীবনটা কাটিয়ে দেয়। গ্রাম্য জীবনের এই সহজ সরলতা আমাকে অনেকাংশেই প্রভাবিত করেছে।

এই অভিজ্ঞতার আলোকে আমি পরবর্তীতে লে করবুজিয়ের সাথে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করি। তিনি ছিলেন আমার একজন অনন্য শিক্ষক, যার কাছ থেকে আমি স্থাপত্যের কিছু বেসিক কনসেপ্ট যেমন- স্পেইস, ফর্ম, আলো, বা্যুপ্রবাহ প্রভৃতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করি; এবং কিভাবে এই উপকরণসমূহকে বাহ্যিক কাঠামোর সাথে সমন্বয় করে একটি পূর্ণ স্থাপনায় রূপ দেয়া যায়, অর্থাৎ স্থাপত্যে পরিণত করা যায়, তা শিখতে পারি। এক্ষেত্রে আমি নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করি, কারণ স্থাপত্যে আমার হাতেখড়ি হয়েছে এরকম কয়েকজন অসম্ভব প্রতিভাবান স্থপতিদের সাথে কাজ করার মাধ্যমে। আমার এই শিক্ষকদের মধ্যে একজন লে করবুজিয়ে এবং আরেকজন লুই আই কান। তাদের মধ্যে প্রথমজন ছিলেন আমার ‘গুরু’, এবং দ্বিতীয় জন ‘যোগী’। কানকে আমার কাছে সবসময় একজন আদর্শ যোগী মনে হতো; কারণ স্থাপত্যের মূল গাণিতিক নিয়মের বাইরে যে একটি আপেক্ষিক এবং আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে, সেটির শিক্ষা আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি। এবং এই আধ্যাত্মিক দিকটি সামগ্রীক প্রেক্ষাপটে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যার উপস্থিতি নিশ্চিত হলে একটি নির্জীব স্থাপনায় প্রাণের সঞ্চারণ ঘটে, অর্থাৎ স্থাপত্যটি পরিপূর্ণতা লাভ করে।

লে করবুজিয়ে এবং লুই আই কান, এমন দুইজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যারা সর্বদা নিজেদেরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতেন। এক্ষেত্রে হয়তো তারা তাদের নিজস্ব দর্শন ও সৃষ্টির মধ্যে নিজেদেরকে খুজে বেড়াতেন। আমি জানিনা। এই বিষয়টি আমার কাছে এখনো রহস্যময় মনে হয়। আমি নিজেও প্রতিনিয়ত নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি কখনো আমার নিজের ভবিষ্যৎ বা ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করিনি। এই বিষয়গুলো আমার কাছে অনেকটাই অনাহূত। তবে নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা আমার মধ্যে সর্বদা বিদ্যমান। আমি নিজেও জানিনা এই যাত্রার শেষ কোথায়। বা এর আদৌ কোন শেষ আছে কি!

একটি টেকসই পৃথিবীর স্বপ্ন

সমকালীন স্থাপত্যে “টেকসই উন্নয়ন” (sustainability) ধারণাটি বেশ প্রচলিত একটি কনসেপ্ট। কিন্তু এ ধারণাটির যথাযথ ব্যবহার নিয়ে আমার কিছুটা আপত্তি রয়েছে। আমরা এ ব্যাপারটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করছি যেন এটি বাহির থেকে আসা নতুন কিছু। যেন, আমরা হঠাৎ করে চোখ খুলে এটিকে দেখছি; এবং এর সাথে আমাদের নিজস্ব কোন সম্পর্ক নেই। অথচ ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। সাস্টেইনিবিলিটি এমন একটি কনসেপ্ট, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের আবহকালীন সমাজব্যবস্থার সাথে মিশে আছে। পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার মধ্যে সমাজে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকেয়ে রাখার স্বার্থে নিজস্ব চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার তাগিদেই আমরা হাজার বছর ধরে এর চর্চা করে আসছি।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। যদি আপনার একটি পরিবার থাকে, এবং আপনি আপনার পরিবারকে ভালোবাসেন, তাহলে সাস্টেইনিবিলিটির প্রশ্নটি কখনোই আপনার মনে আসবে না। বরং প্রাকৃতিকভাবেই অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তির মতো এ ব্যাপারটি আপনার ব্যক্তিসত্তার একটি অংশে পরিণত হবে। আপনি স্বাভাবিকভাবেই চাইবেন আপনার ভালোবাসার মানুষগুলো আজীবন বেঁচে থাকুক, ভালো থাকুক। এই ব্যাপারে কোন ধরনের দ্বিধা বা সংশয় আপনার মধ্যে কাজ করবেনা। কারণ আমরা যখন কাউকে বা কোন কিছুকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসি, আমরা সবসময় অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তার সার্বিক মঙ্গল কামনা করি। স্বাভাবিকভাবেই আমরা চাই যাতে সে দীর্ঘজীবী বা দীর্ঘস্থায়ী হয়; এবং একটি সুখী ও সমৃদ্ধশীল জীবনযাপন করতে পারে। এটাই আমাদের মানবিক প্রবৃত্তি।

এখন আমার প্রশ্ন, আমাদের এই পৃথিবীটা কি আমাদের আপন নয়? সমগ্র মহাবিশ্বের মধ্যে একমাত্র এই পৃথিবীই আমাদের একান্ত নিবাস; আমাদের বাসস্থান। এখানেই আমাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা। এখানেই আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন-ভালোবাসা, সর্বোপরি জীবনের জয়গান। এই পৃথিবী আমাদের মায়ের মতো। তাহলে আমরা কেন এই পৃথিবীটাকে নিয়ে ভাববোনা! আমরা কেনো চাইবোনা আমাদের মা ভালো থাকুক! এই পৃথিবীর আকাশ, মাটি, পানি, বায়ু কোন কিছুই আমাদের নিজস্ব সত্তা থেকে আলাদা নয়; বরং এরা আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ।

এক কথায় বলতে গেলে, সত্যিকারের সাস্টেইনিবিলিটি জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য উপায় এবং চিন্তাভাবনার অবিচ্ছেদ্য পদ্ধতির সমন্বয় ছাড়া আর কিছু না। তাই আমার মতে, এখন সময় হয়েছে এই বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার। আমরা যেদিন এই পৃথিবীটাকে নিজেদের পরিবারের মতো ভালোবাসতে পারবো, সেদিনই প্রকৃত সাস্টেইনিবিলিটি অর্জন করা সম্ভব হবে। তাপমাত্রা, আলো, বায়ুপ্রবাহ এগুলো প্রকৃতির আশীর্বাদ। এর মধ্যে বেঁচে থাকাটাই আনন্দের, কারণ জীবন মানেই অফুরন্ত সম্ভাবনা; সৃষ্টি সুখের উল্লাস! আর আমাদের চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ অসম্ভব সুন্দর। এই সৌন্দর্য্যকে যে কোন মূল্যে সংরক্ষণ করতে হবে; কারণ পরিবেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আমাদের স্থপতিদেরকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য চর্চার মাধ্যমে একটি টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলাই হোক আমাদের আগামী দিনের লক্ষ্য। কারণ, এ পৃথিবীই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন; আমাদের আপন ঠিকানা।


About the Author(s): 

Mahin is a passionate writer and architecture graduate from Shahjalal University of Science and Technology (SUST), Sylhet, Bangladesh.  Mahin’s blog:  https://mahinique.wordpress.com

Ziaur is a rising digital artist and architecture student of SUST. Ziaur’s blog : https://www.artstation.com/ziaurovi


ABOUT THE AUTHOR

ARTICLES BY THE AUTHOR

PEOPLE ALSO VIEW