প্রত্যেকটি মানুষের সিগনেচার আলাদা; স্বতন্ত্র। আপনার স্বাক্ষরের সাথে আমার স্বাক্ষর মিলবে না। আপনি পাশাপাশি দুইজন ব্যক্তির স্বাক্ষর তুলনা করলে সেখানে খুঁজে পাবেন বৈচিত্র্যতা; এবং বিষয়টি স্বাভাবিক। একইভাবে দুইজন মানুষের রুচি ও মননে ভিন্নতা থাকে, সৌন্দর্য্যবোধ আলাদা হয়। আমার রুচিবোধের সাথে সবার রুচিবোধ মিলতে হবে এমন কোন কথা নেই। একই জিনিস কারো কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, আবার কারো কাছে তা হতে পারে নিতান্তই সাধারণ কিছু! এই সৌন্দর্য্যবোধ কি পরিমাপ করা যায়? একে কি কোনভাবে ছকে বেধে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে? না। আমি মনে করি, এ ধরনের তুলনার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। আপনার রুচিবোধ আপনার কাছে, আমারটা আমার কাছে। বৈচিত্র্যের মধ্যেই সৌন্দর্যের তৃপ্তি।
স্থাপত্যের ভাষা
স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি মিল আছে; তা হলো এদের মাধ্যমে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাজমহল বলুন, পিরামিড বলুন কিংবা আইফেল টাওয়ার, প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে তার নিজস্ব এক ধরণের অব্যক্ত ভাষার প্রকাশ বিদ্যমান; যেখানে তার স্বয়ং উপস্থিতিই দর্শনার্থীদের মনে এক ধরনের অদৃশ্য আবহ তৈরি করতে সক্ষম। আপনি যখন এসব জায়গায় যাবেন এবং আনমনে স্থাপনাটির সামনে যেয়ে দাঁড়াবেন, অনেকটা নিজের অজান্তেই আপনি সেই স্থাপত্যের অলিখিত ভাষাটুকু বুঝতে পারবেন, হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন তার অপার মহীমা। অনেকটা বইয়ের পাতায় লেখা গল্পের মত; যেটা আপনি চাইলেই যে কোন সময় পড়ে নিতে পারেন। এভাবেই যুগ যুগ ধরে এসব স্থাপনার মাধ্যমে তাদের নির্মাতা শিল্পী ও স্থপতিদের মনের আবেগ ও অনুভূতিটুকু স্থান, কালের গণ্ডি ভেদ করে দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রবাহিত হয়।
আবার মুদ্রার ওপিঠও আছে। ধরুন, আপনি প্যারিসে একটি আর্টের ভবন তৈরি করতে চান। এখন কাজ শুরুর আগেই কিন্তু আপনি এক প্রকার বিপদে পড়ে যাবেন! প্যারিসে এত এত অনবদ্য স্থাপত্যের নিদর্শন, অমর কীর্তি- যে, আপনাকে সূচনাতেই এক অভাবনীয় প্রতিযোগিতার মধ্যে পরে যেতে হবে। আপনার নতুন স্থাপনাটি কি প্যারিসের শৈল্পিক স্থাপত্যসম্ভারের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারবে? সাধারণ মানুষ কি এই নতুন স্থাপত্যটিকে গ্রহণ করতে পারবে? আমি জানিনা; এরকম পরিস্থিতিতে আমার মধ্যে একটি অনিশ্চয়তা কাজ করবে, এবং এই পুরো বিষয়টি আমার জন্য অত্যন্ত রোমাঞ্চকর!
স্থাপত্য ও শিল্প
বেশিরভাগ মানুষ স্থাপত্যকে আর্ট বা শিল্প হিসেবে বিবেচনা করতে চায়না। এর কারণও আছে। স্থাপত্য শুধুমাত্র আর্ট বা শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করেনা; বরং এর মধ্যে মানবিকতার অন্যান্য গুণাবলীর মাপকাঠি বিরাজমান। একটি স্থাপনা যখন তার ব্যবহারকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তখনই সেটি পরিপূর্ণ স্থাপত্য হয়ে ওঠে। আপনি যে ভবনটি ডিজাইন করছেন তা হবে সার্বজনীন; সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল, মাথা গোঁজার ঠাই, সর্বোপরি নির্ভরতার প্রতীক। আমি এ ব্যাপারে একমত যে স্থাপত্যের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এটি তৈরি হবে মানুষের ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এটাও ঠিক যে, স্থাপত্যের এই প্রায়োগিক বৈশিষ্ট্য অনেক সময় স্থাপত্যের শৈল্পিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। অর্থাৎ, এটি এমন এক ধরনের সীমাবদ্ধতা, যা স্থাপত্যকে তার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাটুকু পূরণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলতে চায়। স্থাপত্য তখন একটি ছকের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পরে। কিন্তু আমি মনে করি, এই ছকের বৃত্তটুকু ভেঙ্গে স্থাপত্যকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব; কারণ, স্থাপত্য ও শিল্প কিন্তু পরস্পরবিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক।
“অতীত” থেকে প্রেরণা
স্থাপত্যে মডার্নিজম (modernism) একটি বৈপ্লবিক ধারার সূচনা করে। কিন্তু ষাটের দশকের শেষদিকে যখন ধীরে ধীরে মডার্নিজমের গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে, তখন হঠাৎ করে ইতিহাসের অন্তঃপুর থেকে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান স্থাপত্যকলার নির্দিষ্ট কিছু ধারাকে পুনর্জীবিত করার মাধ্যমে ধ্রুপদী স্থাপত্যকে ফিরিয়ে আনার একটা প্রবণতা শুরু হয়, যেটিকে তখন পোস্ট-মডার্নিজম (post-modernism) নাম দেয়া হয়। ব্যক্তিগতভাবে, এই সামগ্রীক ব্যাপারটিতে আমার কিছু আপত্তি ছিলো। এবং আমি জানিনা আমি এটা কেন করেছিলাম, তবে আমার মনে আছে পোস্ট-মডার্নিজমের উত্থানের প্রসঙ্গে আমি একবার একটি লেকচারে বলেছিলাম, “আপনারা যে এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে দুই হাজার বছর আগের গ্রীক মন্দিরগুলোকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছেন তার যুক্তিটা কি! আপনারা কেনো তাহলে ৩০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে মৎস্যযুগে চলে যাচ্ছেন না, যখন পৃথিবীতে শুধু মাছেরা বিচরণ করতো! আইডিয়া বা অনুপ্রেরণার জন্য অতীতে যদি যেতেই হয়, তাহলে একেবারে সুদূর অতীতে যেতে বাধা কোথায়!”
আমি আসলে জানিনা এটা কেন বলেছিলাম। এটা অনেকটা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে আমার মাথায় চলে এসেছিলো। কিন্তু এরপর যা হলো, আমি আনমনে বিষয়টা নিয়ে ভাবা শুরু করলাম, এবং অনেকটা মনের অজান্তেই মাছের স্কেচ করা শুরু করলাম! মাছ নিয়ে আকিবুকির এক ফাকে আমি আবিষ্কার করলাম যে মাছের আকার, আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এক ধরনের গতিশীলতা রয়েছে, মুভমেন্টের বহিঃপ্রকাশ আছে। হুট করে মাথায় আসা এই অবান্তর আইডিয়াটা যেন ছিলো এক অফুরন্ত সম্ভাবনার আধার! আমার সামনে যেন এক অসীম সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেলো। আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছিলাম বিভিন্ন আকৃতি ও প্রতিকৃতির সঞ্চারণ, সমাহার। এক সময় আমি এই অপার সম্ভাবনাগুলোকে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করতে শুরু করলাম। এক কথায় এটি ছিলো প্যান্ডোরার বক্স (Pandora’s Box) এর মত এক অসীম গোলকধাঁধা, একটি নতুন দিগন্ত, এক নতুন খেলার মাঠ! এবং এই প্রেক্ষাপট থেকেই শুরু হয় আমার প্রচলিত ধারার বাইরে চিন্তা করার মানসিকতা; প্রচলিত ফর্মগুলোকে ভেঙ্গেচুড়ে নতুন কিছু বের করে এনে স্থাপত্যকে অন্য ভাবে দেখার আকাঙ্ক্ষা।
আমি বলবো, আর্ট বা শিল্প তৈরি করার প্রক্রিয়াটা আসলে ভালোবাসার প্রক্রিয়া! এবং এই ভালবাসা সমগ্র পৃথিবীর প্রতি। আমি আর্টের প্রতি ভীষণভাবে অনুরক্ত। অবসর সময় পেলেই আমি আর্ট নিয়ে পড়াশুনা করি, কিংবা গবেষণা করি। আর্টের প্রতি আমার এই বিরামহীন ভালোবাসার উৎস সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই; তবে জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমি বুঝতে পারি আমার বেশিরভাগ বন্ধু বা সহকর্মীরাই আর্টিস্ট বা শিল্পী। হ্যা, বন্ধুদের মধ্যে অল্প সংখ্যক স্থপতিও আছেন; তবে আর্টিস্টদের সংখ্যাই বেশি। স্থাপত্যের মধ্যে আর্টকে খুজে নেয়ার যে প্রবণতা আমার মধ্যে আছে সেটাই এর কারণ কিনা আমি জানিনা, তবে আমি মনে করি স্থাপত্যের মধ্যে শিল্পসত্বার উপস্থিতি ও বিকাশের কোন বিকল্প নেই।
প্রাণের স্পন্দন
কিভাবে স্থাপত্যের মধ্যে আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটে? এমন কোন বৈশিষ্ট্য কি আছে যার উপস্থিতিতে একটি নির্জীব স্থাপনায় প্রাণের সঞ্চার হয়; এবং তা অসার জড়বস্তু থেকে জীবন্ত হয়ে ওঠে? এ এমন এক জটিল প্রশ্ন যার উত্তর আমি নিজেও পুরোপুরি জানি না। অনেক বছর ধরে আমি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি।
ব্যক্তিগতভাবে আমি নৌকা চালাতে পছন্দ করি, এবং নৌকাবাইচ আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি খেলা। চলন্ত নৌকা, বহমান নদী ও প্রকৃতির স্বতঃস্ফুর্ত স্পন্দন আমাকে আকৃষ্ট করে, যেখানে গতির মধ্যে স্থিতির বিরাজ! সরলরেখার চেয়ে বক্ররেখার মধ্যেই যেন বেশি আবেগ খুঁজে পাই আমি। চারপাশের বেশিরভাগ ভবন আমার কাছে স্থিতিশীল (static); সাধারণ সরলরৈখিক ফর্মের সমন্বয়ে গঠিত জড়বস্তু বলে মনে হয়। কিন্তু আমার কাছে এই জড়তা ভালো লাগেনা। আমি মুভমেন্ট পছন্দ করি যেখানে অনুভব করা যাবে গতিশীলতার স্পন্দন, অর্থাৎ নদীর স্রোতের মতই প্রবাহিত হবে অনুভূতি! যেখানে মনে হবে কোন কিছু থেমে নেই, সবকিছু সচল; যেখানে স্পেইসের মধ্যে থাকবে চলমান আন্দোলন এবং অনুভূত হবে প্রাণের স্পন্দন। ইট, পাথর, কনক্রিট আর স্টিলের জঞ্জালে আবদ্ধ খাঁচার মধ্যে অনুভূতির এই অনুরণন যদি তৈরি করা যায়, অসার নির্জীব কাঠামোকে যদি জীবন্ত করে তোলা যায়, এর চেয়ে অসাধারণ অনুভূতি আর কি হতে পারে!
একজন স্থপতি এবং একজন শিল্পী হিসেবে এই অনুভূতিটুকুই আমাকে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রেরণা যোগায়। সৃষ্টি সুখের স্বপ্নজালে বিভোর আমি একজন ক্ষুদ্র মানুষ, হয়তো এভাবে আমার কাজের মাধ্যমেই আবিষ্কার করতে চাই আমার নিজস্ব স্বকীয়তা, আমার দর্শন; আমার ‘সিগনেচার’।
About the Author(s):
Mahin is a passionate writer and architecture graduate from Shahjalal University of Science and Technology (SUST), Sylhet, Bangladesh. Mahin’s blog: https://mahinique.wordpress.com
Ziaur is a rising digital artist and architecture student of SUST. Ziaur’s blog : https://www.artstation.com/ziaurovi